বিয়ের ঠিক ছয় মাস আগে থেকে উপসর্গ দেখা দিল। কিন্তু জ্বর, শরীরের ব্যথা-বেদনা, দুর্বলতা ও কমতে থাকা ওজন ইত্যাদি বিদ্যাপতি ভগতের স্বাস্থ্যের উপর যতই গুরুতর প্রভাব ফেলুক না কেন চিকিৎসার প্রয়োজন বিবেচনার মধ্যেই আসেনি। অবশ্য যে দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.০২ শতাংশ সেখানে এসব তেমন বিস্ময়কর কোনও ব্যাপারই নয়। আর তার উপর তিনি একজন মহিলা – বাস করেন এমন এক সমাজে যেখানে পরিবারের পুরুষ সদস্যটির চিকিৎসা সর্বদাই অগ্রাধিকার পায়।

“২০১৩ সালে বিয়েটা স্থগিত করা গেল না। বিয়ের ঠিক একমাস পর, আমার কালাজ্বর ধরা পড়ল। আমার স্বামী যাতে আবার বিয়ে করে সে ব্যাপারে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জোর করতে লাগল,” বিদ্যাপতি জানাচ্ছেন। গত দুই বছর ধরে তিনি বিহারের সারণ জেলার দরিয়াপুর ব্লকের বেলা গ্রামে তাঁর বাবা-মায়ের বাড়িতেই আছেন।

Vidyapati Rai, 25, displays almost no signs of PKDL yet has been abandoned by her husband
PHOTO • Drugs for Neglected Diseases Initiative (DNDi)

‘শুরুতে আমার মুখ কালো হয়ে গেল , তারপর আমার থুতনি , তারপর গলা’ , বলছেন বিদ্যাপতি

বিদ্যাপতির এই রোগটির বিজ্ঞানসম্মত নাম ভিসেরাল লিশম্যানিয়াসিস (ভিএল) যা আসলে বেলেমাছির কামড়ে সৃষ্ট একটি বাহক-বাহিত ব্যাধি। বেলেমাছি আদতে একটি মশার এক তৃতীয়াংশ আকারের প্রাণী। অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, আর্দ্র স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া, গাছগাছালির প্রাচুর্য আছে এমন পরিবেশে এই জীবাণুটি বিস্তার লাভ করে। রোগটির আক্রমণে মূলত অস্থিমজ্জা, প্লীহা এবং যকৃৎ ইত্যাদি প্রত্যঙ্গ ব্যাধিগ্রস্ত হয়, অনেকক্ষেত্রেই এর প্রভাবে কয়েক মাস বা কয়েক বছর পরে ত্বকের ক্ষতগুলির মধ্যে দিয়েও রোগটি প্রকট হয়ে উঠতে পারে। ড্রাগস ফর নেগলেক্টেড ডিজিজেজ ইনিশিয়েটিভ (ডিএনডিআই) নামের একটি বিশ্বব্যাপী সংগঠনের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, এশিয়ার ভিএল রোগাক্রান্তদের ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই এই ক্ষত বা বিকার দেখা যায়।

লোকহিতকর বেসরকারি সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস বলছে, “বিশ্ব জুড়ে পরজীবীঘটিত রোগগুলোর মধ্যে কালাজ্বর দ্বিতীয় মারণ ব্যাধি... ম্যালেরিয়ার পরেই তার স্থান।” বিগত কয়েক দশকে ভারতে কালাজ্বরের আধিক্য হ্রাস পেলেও, এই দেশ বেশ কয়েকবার কালাজ্বর ‘নির্মূল করার’ নির্দিষ্ট সময়সীমা পূর্ণ করতে অক্ষম হয়েছে  - ২০১০, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে।

ভিএল-এর যথাযথ চিকিৎসা না হলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত, আর প্রাণঘাতক না হলেও কালাজ্বর-পরবর্তী চর্মরোগের (পোস্ট কালাজ্বর ডার্মাল লিশম্যানিয়াসিস, বা পিকেডিএল) প্রভাবে গভীর ক্ষতজনিত ভয়াবহ বিকৃতি ঘটে। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ আসে সামাজিক কলঙ্ক, লজ্জা, এমনকি পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনাও – রোগের যে প্রভাবটা পড়েছিল বিদ্যাপতির উপর।

“শুরুতে আমার মুখ কালো হয়ে গেল, তারপর আমার থুতনি, তারপর গলা,” সারণে বাবা-মার বাড়িতে বসে বিদ্যাপতি বলছিলেন – রাজ্যের মধ্যে এই জেলাতেই সর্বাধিক কালাজ্বরের ঘটনা ঘটে।

তাঁর স্বামী রাজু ভগত, মরশুমি অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বেঙ্গালুরু শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, বিদ্যাপতিকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তাঁর পিতামাতার জবরদস্তি সত্ত্বেও স্ত্রীকে মোটেই পরিত্যাগ করবেন না। অথচ রাজু তাঁকে বেঙ্গালুরু নিয়ে যাননি, এমনকি বিহারে তাঁর পিতামাতার বাড়িতেও থাকতে দেননি। “কে তোমার দেখাশোনা করবে? সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বরং নিজের মায়ের কাছে গিয়ে থাকো” তিনি যুক্তি দেন। অথচ ছুটিতে বাড়ি এলেই তিনি বিদ্যাপতিকে ডেকে পাঠাতেন। এই সহবাসের ফলস্বরূপ বিদ্যা দুবার গর্ভধারণ করেন। প্রথমবার, মৃত পুত্রসন্তান প্রসব করেন। দ্বিতীয়বার যে শিশুকন্যাটি জন্মায় সে মাত্র কয়েক ঘন্টা বেঁচেছিল, তাঁর রোগের চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সম্ভবত এমনটা ঘটেছিল।

The Sand fly which causes kala-azar thrives in dense vegetation and moist temperatures
PHOTO • Drugs for Neglected Diseases Initiative (DNDi)
Asmat Ali, 19 has lived with PKDL for 9 years but treatment is not on his list of priorities
PHOTO • Drugs for Neglected Diseases Initiative (DNDi)

আর্দ্র স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া , গাছগাছালির প্রাচুর্য আছে এমন জায়গাই কালাজ্বর সংক্রমণের জন্য দায়ী বেলেমাছির বংশবৃদ্ধির আদর্শ পরিবেশ। আসমত আলি (ডানদিকে) বিগত নয় বছর ধরে পিকেডিএল –এর জীবাণুটি নিয়েই বেঁচে আছেন; তাঁর মুখে অসংখ্য গভীর ক্ষত, তিনি অবশ্য নির্বিকার

স্বামীর অপব্যবহার, বড়ো ননদের গঞ্জনা এবং প্রায়শই ‘অভিশপ্ত’ আখ্যা পাওয়ার পরেও বিদ্যাপতি ভগতের বিশ্বাস একটি সন্তান তাঁর এই সব ক্ষতের উপশম হয়ে উঠবে। “আমার মতো অশিক্ষিত এক মহিলা আর কিই বা করতে পারে? যদি একটা সন্তান হয়, তাহলেই এই অবস্থা ঠিক হবে,” তিনি মৃদুস্বরে বলেন।

দেশের মধ্যে বিহারেই কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক। জাতীয় বাহক-বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম) সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৮ সালে দেশে কালাজ্বরের ৩,৮৩৭টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে যার প্রায় প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটিই বিহারের ঘটনা। সারাদেশের মধ্যো সবচেয়ে ভয়াবহ সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকগুলো বিহার থেকেই উঠে আসে, এবং রাজ্যের দরিদ্র জনসাধারণের এই রোগ সরকারি মনোযোগ আকর্ষণ করে না সেই অর্থে। মহিলারা পিকেডিএল-জনিত দুর্দশার চূড়ান্ত ভুক্তভোগী।

বিদ্যাপতির স্বামীর গ্রাম রেভেলগঞ্জ ব্লকের মোবারকপুরেই মানুষ ১৯ বছর বয়সী টেম্পো চালক আসমত আলি অবশ্য নিরুদ্বিগ্ন। নিরাপত্তাহীনতার লেশমাত্র নেই তাঁর মধ্যে। তাঁর মুখের ক্ষতগুলি বিদ্যাপতির তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশি এবং গভীরতর। জানালেন এই ক্ষতগুলি নিয়েই তিনি বিগত নয় বছর ধরে বেঁচে আছেন, চিকিৎসার ব্যাপারটা তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পায়নি। নির্বিকার চিত্তে তিনি বলেন, “অনেক কাজ করার আছে।” অবশ্য তিনি তাঁর পাড়ার এমনই একটি মেয়ের কথা শোনালেন যে তাঁরই মতো কষ্ট ভোগ করছিল এবং চিকিৎসাও করায়। “এমন মেয়েকে কেই বা বিয়ে করতে চায়?” তাঁর প্রশ্ন।

বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত সামাজিক পরিচয় যেটাই হোক না কেন, লিঙ্গ বৈষম্য এবং মান্ধাতার যুগের ধ্যানধারণা মহিলাদের চিকিত্সার প্রয়াস ও তাকে বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটা বিরাট বড়ো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

Lalmati Devi, 51, discontinued treatment as she found it physically uncomfortable
PHOTO • Drugs for Neglected Diseases Initiative (DNDi)

‘আমার মুখ থেকে শুরু হয়েছিল , তারপর ছড়িয়ে পড়ে...’ , লালমতি দেবী বলছেন

দেশের মধ্যে বিহারেই কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক। জাতীয় বাহক-বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম) সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৮ সালে দেশে কালাজ্বরের ৩,৮৩৭টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে যার প্রায় প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটিই বিহারের ঘটনা

এই যেমন সারণ জেলার পারসা ব্লকের ভেলদি গ্রামে ৫১ বছর বয়সী লালমতি দেবীর ( উপরের কভারচিত্রে ) ৩০ বছরের বিবাহিত জীবন এবং চার সন্তানের জন্মও তাঁর স্বাস্থ্যকে সুনিশ্চিত করতে পারেনি। মাস ছয়েক আগে তাঁর দফায় দফায় জ্বর আসতে থাকে। তাঁর স্বামী রাজদেব রায় জানান তিনি কাজকর্মে (নির্দিষ্ট করে কাজটি উল্লেখ করেননি) এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যেতে পারেননি। অগত্যা গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক এবং স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না।

“কেউ কেউ বলেছিল যে এটা এক ধরনের অ্যালার্জি যা নিজে থেকেই খসে পড়বে। উপসর্গ আমার মুখ থেকে শুরু হয়েছিল, তারপর আমার পা এবং পেটে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের লোকেরা আমার কষ্ট দেখে হাসাহাসি করত,” অনেক অনুরোধের পর এসব কথা জানালেন তিনি। লালমতির পরিবারে অবশ্য কালাজ্বর কোনও অপরিচিত রোগ নয়। তাঁর কনিষ্ঠতম ছেলেটি চারবছর আগে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। গর্বিত রাজদেবের ঘোষণা, “আমি ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখন সে রোগমুক্ত।” অথচ, বহু বিলম্বের পর স্ত্রীর রোগ ধরা পড়ার পর চিকিত্সা শুরু হলে লালমতির শারীরিক কষ্ট হতে থাকায় যখন তিনি চিকিৎসা স্থগিত রাখলেন তখন রাজদেব তেমন গা করেননি। “ও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে, তখন ওষুধ খাবে,” কাঁধ নেড়ে এই নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া দেন রাজদেব। এই দীর্ঘ, বিষাক্ত এবং শারীরিকভাবে কষ্টকর পিকেডিএল-এর চিকিত্সার জন্য যে পারিবারিক সহায়তা একান্ত প্রয়োজন সেটা রাজদেব বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না।

২০২০ সালের মধ্যে কালাজ্বরকে নির্মূল করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে বিহার। ডিএনডিআই ইন্ডিয়ার  পরিচালক সুমন রিজাল বলছেন, “নারী ও শিশুদের মতো সামাজিকভাবে দুর্বল গোষ্ঠীগুলির কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে গৃহীত বিশেষ কর্মসুচিগুলি অবশ্যই কালাজ্বর নির্মূল করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।” এই পথেই হাঁটতে হবে বিহারকে যদি সত্যিই তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার সদিচ্ছা থেকে থাকে। নারীর স্বাস্থ্যকে ঘিরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই তথা অবহেলা ও উদাসীনতার মোকাবিলার দায়দায়িত্ব শুধু মহিলাদের কাঁধে চাপিয়ে দিলে সুরাহা হবে না।

বাংলা অনুবাদ : স্মিতা খাটোর

Puja Awasthi

Puja Awasthi is a freelance print and online journalist, and an aspiring photographer based in Lucknow. She loves yoga, travelling and all things handmade.

Other stories by Puja Awasthi
Translator : Smita Khator
smita.khator@gmail.com

Smita Khator, originally from Murshidabad district of West Bengal, is now based in Kolkata, and is Translations Editor at the People’s Archive of Rural India, as well as a Bengali translator.

Other stories by Smita Khator