‘‘১৩০,৭২১টি গাছ কাটার প্রভাব নেহাতই তুচ্ছ।’’

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সম্বলপুর ডিভিশনের রিজিওনাল চিফ কনজার্ভেটর অফ ফরেস্টস এর সিনিয়র বন আধিকারিক এমনটাই লিখেছিলেন। ওড়িশার সম্বলপুর এবং ঝাড়সুগুডা জেলার সীমান্তে তালাবিরা এবং পাত্রপালি গ্রামের ২৫০০ একর বনজমি যাতে কয়লাখনির হাতে যাতে যায়, সে ব্যাপারেই সুপারিশ করছিলেন তিনি।

দুই গ্রামের অধিবাসীরা ইংরেজিতে লেখা নথিগুলি চোখে দেখেননি, এগুলির খসড়া  বন দপ্তরের আধিকারিকরা তৈরি করেছিলেন। এই নথিগুলির ভিত্তিতেই ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তালাবিরা ২ এবং ৩ খোলামুখ কয়লা খনি বন দপ্তরের ছাড়পত্র পায়। অথচ এখানকার অধিবাসীরা এই আধিকারিকের সঙ্গে আদৌ একমত নন। মজার ব্যাপার এই আধিকারিক আবার সরকার মনোনীত 'সংরক্ষক'!

গত দুই সপ্তাহে হাজার হাজার গাছ (সংখ্যাটা ঠিক কত, এখনও স্পষ্ট নয়) কাটা হয়েছে, যাতে খনির পথ সুগম হয়। গ্রামবাসীরা বলছেন, কোনও বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়নি। এই গ্রামের ২১৫০ জন অধিবাসীর মধ্যে (আদমশুমারি ২০১১) অনেকেই মর্মাহত, ক্ষুব্ধ এবং শঙ্কিত। তাঁদের বক্তব্য, বহু দশক ধরে এই অরণ্য তাঁরা রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন, সেটিকে তাঁদের চোখের সামনে নষ্ট করা হচ্ছে, সাহায্য করছে পুলিস আর রাজ্যের সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা।

Left: The road to Patrapali village winds through dense community-conserved forests. Right: In the mixed deciduous forests of Talabira village, these giant sal and mahua trees lie axed to the ground
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: The road to Patrapali village winds through dense community-conserved forests. Right: In the mixed deciduous forests of Talabira village, these giant sal and mahua trees lie axed to the ground
PHOTO • Chitrangada Choudhury

বাঁদিকে: জনজাতি সংরক্ষিত ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পাত্রপালি গ্রামে যাওয়ার রাস্তা। ডানদিকে: তালবিরা গ্রামের পর্ণমোচী অরণ্যের মধ্যে কাটা যাওয়া সুবিশাল শাল আর মহুয়া গাছগুলি পড়ে রয়েছে

এই পদক্ষেপের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাবে কাটা পড়তে থাকে গাছ। গ্রামবাসীরা বলছেন, ৫ই ডিসেম্বর ভোর না হতেই ধ্বংসলীলা শুরু হয়। তালাবিড়ার মুণ্ডা আদিবাসী অধ্যুষিত জনপদ মুণ্ডাপাড়ার তরুণ বাসিন্দা মানস সালিমা জানালেন, “ওরা হঠাৎ এসে গাছ কাটতে শুরু করলে, আমাদের তখন ঘুমও ভাঙেনি। খবর পাঁচকান হতেই গ্রামবাসীরা গাছ কাটা থামাতে ছুটে আসে, কিন্তু চারদিকে তখন বিরাট সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন ছিল।”

‘‘আমরা ১৫০-২০০ জন একত্রিত হই, ঠিক করি কালেক্টরের কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এই সব কার্যকলাপ আর গাছ কাটা বন্ধ করতে বলব,” জানালেন মুণ্ডাপাড়ার আর এক অধিবাসী ফকিরা বুধিয়া। ‘‘কিন্তু আমাদের বলা হল, যারা কোম্পানির বিরুদ্ধে যাবে বা কোম্পানির কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।”

ঘন মিশ্র পর্ণমোচী অরণ্যের মধ্যে ছড়ানো দুটি গাম তালাবিরা এবং পাত্রপালি। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, ডিসেম্বরের তপ্ত দুপুরে অরণ্যের সবুজ ছায়ায় ক্লান্তি কেটে যাচ্ছিল। প্রচুর কয়লা খনি, স্পঞ্জ আয়রন প্ল্যান্ট এবং অন্যান্য শিল্পে ভরা এই ঝাড়সুগুডা অঞ্চল, প্রতি বছর ওড়িশার উষ্ণতম তপ্ত এলাকাগুলির মধ্যে জায়গা করে নেয়।

এখানকার গ্রামগুলির বাসিন্দাদের বেশিরভাগই মুণ্ডা ও গোণ্ড আদিবাসী। তাঁরা মূলত ধান, সবজি চাষ করেন এবং বনজ দ্রব্য আহরণ করেন। তাঁদের মাটির নিচেই কয়লার স্তর।

Left: Suder Munda says of the tree felling, 'We feel like our loved ones are dying'. Centre: Bimla Munda says the forest is a vital source of survival for them, and they have not awarded consent to the coal mining on the land.  Right: Achyut Budhia is among the villagers who would serve on patrol duty to protect the forests – a tradition of community protection called thengapalli
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: Suder Munda says of the tree felling, 'We feel like our loved ones are dying'. Centre: Bimla Munda says the forest is a vital source of survival for them, and they have not awarded consent to the coal mining on the land.  Right: Achyut Budhia is among the villagers who would serve on patrol duty to protect the forests – a tradition of community protection called thengapalli
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: Suder Munda says of the tree felling, 'We feel like our loved ones are dying'. Centre: Bimla Munda says the forest is a vital source of survival for them, and they have not awarded consent to the coal mining on the land.  Right: Achyut Budhia is among the villagers who would serve on patrol duty to protect the forests – a tradition of community protection called thengapalli
PHOTO • Chitrangada Choudhury

বাঁদিকে: সুন্দর মুণ্ডা গাছ কাটার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘মনে হচ্ছে যেন আমাদের আপনজন কেউ মরে যাচ্ছে।’ মাঝে: বিমলা মুণ্ডা জানান, তাঁদের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন হল জঙ্গল, তাঁরা এই জমিতে কয়লা খনি তৈরির সম্মতি মোটেই দেননি। ডানদিকে: বন রক্ষা করার জন্য অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে পাহারা দেবেন অচ্যুত বুধিয়া — বন পাহারা দেওয়ার এই ঐতিহ্যকে বলা হয় থেঙ্গাপল্লি

বিমলা মুণ্ডা বলেন, ‘‘এই অরণ্য আমাদের মহুল (মহুয়া), শালের রস, জ্বালানি, মাশরুম, শিকড়, কন্দ, ঘাস সব পাই। ঘাস থেকে আমরা ঝাঁটা তৈরি করি, সেটা আবার বিক্রিও করি আমরা। বন দপ্তর এটা বলেই বা কী করে যে এক লাখের উপর গাছ কাটার পরেও তার কোনও প্রভাব পড়বে না?”

তালাবিরা ২ এবং ৩ দুটির বরাত রাষ্ট্রীয় সংস্থার অধীনে নেভেলি লিগনাইট কর্পোরেশন লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে। তারা আবার ২০১৮ সালে আদানি এন্টারপ্রাইস লিমিটেডের (এইএল) সঙ্গে ওই এলাকায় খনির পারিচালন ও তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। পিটিআইকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে (সেই সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল) এইএল বলে, খনিটি থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসবে।

এই কয়লা তোলার জন্য কাটা হয়েছে বড়ো বড়ো গাছ। কেটে দেওয়া শাল গাছ, মহুয়া গাছ পড়ে রয়েছে তালাবিড়া গ্রামের অরণ্যভূমিতে। কিছুটা দূরে সদ্য কাটা গাছ স্তূপ হয়ে রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আদানি সংস্থার এক কর্মী বললেন, ‘‘এখনও অবধি ৭,০০০ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।” আর কোনও প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে চাননি, শুধু বলেছেন ওই সংস্থার কোনও কর্মী, যিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন, তাঁর নাম এবং যোগাযোগের নম্বর দেওয়া ‘‘ঠিক হবে না”।

গ্রামের রাস্তায় ওড়িশা স্টেট আর্মড ফোর্সের সেনাবাহিনীর দল চোখে পড়ল। তাঁরা ওখানে কেন। আমরা জানতে চাইলে তাঁদের একজন বললেন, ‘‘কারণ গাছ কাটা হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, যেখানে গাছ কাটা চলছে, সেখানে নিরাপত্তারক্ষীদের নিযুক্ত করা হয়েছে। আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন তাঁরই এক সহকর্মী তাঁর সেল ফোনে গ্রামে আমাদের উপস্থিতির কথা জানাতে কাউকে একটা ফোন করলেন।

Left: While a  forest department signboard in Patrapali advocates forest protection, officials have issued a clearance for the coal mine, noting that the effect of cutting of 1.3 lakh trees 'will be negligible'. Centre: Bijli Munda of Mundapada, Talabira, with the brooms she makes with forest produce, which she will sell for Rs. 20-25 each. Right: Brooms drying outside houses here; these are just one of the many forest products from which villagers make a livelihood
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: While a  forest department signboard in Patrapali advocates forest protection, officials have issued a clearance for the coal mine, noting that the effect of cutting of 1.3 lakh trees 'will be negligible'. Centre: Bijli Munda of Mundapada, Talabira, with the brooms she makes with forest produce, which she will sell for Rs. 20-25 each. Right: Brooms drying outside houses here; these are just one of the many forest products from which villagers make a livelihood
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: While a  forest department signboard in Patrapali advocates forest protection, officials have issued a clearance for the coal mine, noting that the effect of cutting of 1.3 lakh trees 'will be negligible'. Centre: Bijli Munda of Mundapada, Talabira, with the brooms she makes with forest produce, which she will sell for Rs. 20-25 each. Right: Brooms drying outside houses here; these are just one of the many forest products from which villagers make a livelihood
PHOTO • Chitrangada Choudhury

বাঁদিকে: পাত্রপালিতে বনদপ্তরের একটি নির্দেশিকা যখন বন সংরক্ষণের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তখন আধিকারিকরা কয়লা খনির জন্য ছাড়পত্র জারি করেছে, যাতে বলা হয়েছে, ১.৩ লক্ষ গাছ কাটার প্রভাব ‘নগণ্য’। মাঝে: ঝাঁটা নিয়ে তালাবিরার মুণ্ডাপাড়ার বিজলি মুণ্ডা, বনজ দ্রব্য দিয়ে তিনি ঝাঁটা বানান, প্রতিটি বিক্রি করেন ২০ থেকে ২৫ টাকায়। ডানদিকে: এখানে বাড়ির বাইরে ঝাঁটা শুকোনো হয়; বহু বনজ পণ্যের মধ্যে এটি একটি, এগুলো গ্রামবাসীদের জীবন-জীবিকার সম্বল

ওড়িশার বন ও পরিবেশ দপ্তর কেন্দ্রীয় সরকারকে যে বন সাফাইয়ের নথিপত্র জমা দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, মোট ৪৭০০ একর জমিজুড়ে তৈরি হবে খনি (২ এবং ৩)। তার জেরে উচ্ছেদ হতে হবে ১৮৯৪টি পরিবারকে, যার মধ্যে ৪৪৩টি তফসিলি জাতিভুক্ত পরিবার এবং ৫৭৫টি তফসিলি জনজাতি হিসেবে চিহ্নিত পরিবার।

ভক্তরাম ভোই বললেন, ‘‘আমাদের হিসেব বলছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার গাছ ইতিমধ্যেই কাটা হয়ে গেছে। এবং এটা এখনও চলছে।” তিনি তালাবিরার ফরেস্ট রাইটস কমিটির প্রেসিডেন্ট। (২০০৬ সালের বনাধিকার আইন -এর আওতায় গঠিত গ্রামস্তরের কমিটি এগুলি। এদের কাজ বনাধিকার সম্পর্কিত নানা কাজের পরিকল্পনা ও সেগুলির উপর নজরদারি চালানো। তার মধ্যে রয়েছে বন সংরক্ষণ এবং বনাধিকার সংক্রান্ত নানা দাবি দায়ের করা) তিনি আরও বলেন, ‘‘আমিও বলে উঠতে পারছি না, ওরা ঠিক কত গাছ কেটেছে। প্রশাসন ও কোম্পানি গ্রামবাসীদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এইসব করছে। কারণ আমরা প্রথম দিন থেকেই এর প্রতিবাদ করে আসছি।” সেই ২০১২ সাল থেকে প্রতিবাদ চলছে, যখন গ্রামবাসীরা জেলা প্রশাসনকে তাঁদের বনাধিকার নিয়ে প্রথমবার লিখেছিলেন।

মুণ্ডাপাড়ার বাসিন্দা রিনা মুণ্ডা বলছেন, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষরা এই অরণ্যে থাকতেন, অরণ্য রক্ষা করতেন। আমরাও তাই শিখেছি। প্রতিটি পরিবার থেঙ্গাপাল্লিতে (ওড়িশায় বন রক্ষা করার এক ঐতিহ্য, যেখানে জনগোষ্ঠীর সদস্যরা গাছ কাটা বা পাচার করা থেকে বনকে বাঁচাতে পাহারা দেন) তিন কিলো চাল অথবা টাকা দেয়।

‘‘আর এখন, আমাদের তো বনে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না, যে বনকে আমরা এতদিন ধরে রক্ষা করেছি, বাঁচিয়েছি,” বিমর্ষ শোনালো সুদর মুণ্ডার স্বর। কেমন করে এই ধ্বংস আটকানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে গ্রামবাসীরা তখন স্থানীয় একটি স্কুলে জড়ো হয়েছেন। সুদর মুণ্ডার কথায়, ‘‘ওরা যেভাবে গাছ কেটে ফেলছে, তা দেখতে আমাদের কষ্ট হয়। মনে হয় যেন আমাদের প্রিয়জনরা মরে যাচ্ছে।”

Left: Across the villages, many homes have vegetable farms adjoining homesteads. Right: Many like Hursikes Buriha also depend on paddy cultivation
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: Across the villages, many homes have vegetable farms adjoining homesteads. Right: Many like Hursikes Buriha also depend on paddy cultivation
PHOTO • Chitrangada Choudhury

বাঁদিকে: গ্রামের বহু বাড়িতেই রয়েছে সবজির খেত, ভিটে লাগোয়া। ডানদিকে: হুরসিকেস বুরিহার মতো অনেকেই ধান চাষের উপর নির্ভরশীল

গ্রামবাসীরা জোর দিয়ে জানাচ্ছেন, তাঁরা বহু দশক ধরে বন সংরক্ষণ করছেন। সুরু মুণ্ডা বলেন, “তখন সরকার কোথায় ছিল? এখন কোম্পানি এটা চাইছে। সরকার বলছে, বনটা তাদের, আমাদের পিছিয়ে আসা উচিত।” আর এক প্রবীণ অচ্যুৎ বুধিয়া, যিনি বহুবছর ধরে বন পাহারার কাজ করছেন, তাঁর কথায়, ‘‘গাছগুলো কাটতে দেখে আমার চোখে জল চলে এসেছিল। আমরা আমাদের নিজেদের সন্তানের মতো ওদের রক্ষা করতাম।”

তালাবিরা গ্রামের ফরেস্ট রাইটস কমিটির সদস্য হেমন্ত রাউত বলেন, “গাছ কাটা শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের অনেকেই রাতে ঘুমোতে পারছে না।”

সম্বলপুরের এক পরিবেশবিদ রঞ্জন পণ্ডা। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে কাজ করেন। তিনি জানাচ্ছেন, বন বাঁচাতে গ্রামবাসীদের চেষ্টাটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ঝাড়সুগুডা এবং ইব উপত্যকা এলাকা দেশের সর্বাধিক দূষিত এলাকাগুলির অন্যতম। তাঁর কথায়, ‘‘একটা জায়গা যেটা অতিরিক্ত মাইনিং, তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্পাঞ্চলের নানা কার্যকলাপ ইত্যাদি কারণে ইতিমধ্যেই ভয়ঙ্কর জলাভাব, তাপ, ও দূষণে নাজেহাল, সেখানে নতুন কয়লাখনি, পাওয়ারপ্ল্যান্ট তৈরি করার কোনও অর্থ হয় না। এখানে ১,৩০,৭২১টি পূর্ণবয়স্ক গাছ কেটে ফেলার ঘটনা এলাকার মানুষ এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর আরও চাপ তৈরি করবে, এখানে জনবসতি নষ্ট হয়ে যাবে।”

বহু গ্রামবাসী এই একই মত পোষণ করেন, তাঁরাও এলাকার উষ্ণায়ন বৃদ্ধির কথা বলছেন। বিনোদ মুণ্ডা বলেন, ‘‘বন নষ্ট হয়ে গেলে এখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদি কোনও গ্রামবাসী একটা গাছ কাটেন, তাহলে আমাদের জেল হয়। তাহলে কোম্পানি কেমন করে পুলিশের সাহায্যে এতগুলি গাছ কাটছে?”

Left: Patrapali sarpanch Sanjukta Sahu with a map of the forestlands which the village has claimed in 2012 under the Forest Rights Act. The administration has still not processed the claim. Centre: Villagers here also have documents from 2012 for filing community forest claims. Right: People in Talabira show copies of their written complaint about the forgery of gram sabha resolutions awarding consent for the forest clearance
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: Patrapali sarpanch Sanjukta Sahu with a map of the forestlands which the village has claimed in 2012 under the Forest Rights Act. The administration has still not processed the claim. Centre: Villagers here also have documents from 2012 for filing community forest claims. Right: People in Talabira show copies of their written complaint about the forgery of gram sabha resolutions awarding consent for the forest clearance
PHOTO • Chitrangada Choudhury
PHOTO • Chitrangada Choudhury

বাঁদিকে: বনভূমির একটি মানচিত্র, বনাধিকার আইনের আওতায় ২০১২ সালে গ্রাম এই বনাঞ্চল দাবি করেছিল, মানচিত্র হাতে পাত্রপালির সরপঞ্চ সংযুক্তা সাহু। মাঝে: ২০১২ সাল থেকে ফাইল করা জনজাতির বন অধিকার সংক্রান্ত দাবিপত্রের নথিগুলিও রয়েছে গ্রামবাসীদের কাছে। ডানদিকে: তালাবিরা গ্রামের মানুষ তাঁদের লিখিত অভিযোগের প্রতিলিপি দেখাচ্ছেন, যেখানে গ্রামসভার সিদ্ধান্ত জাল করে বন সাফাইয়ের জন্য সম্মতি দেওয়া হয়েছে

পাশের পাত্রপালি গ্রামের রাস্তাটা গিয়েছে ঘন শাল বনের মধ্যে দিয়ে। এখানে এখনও করাত এসে পৌঁছয়নি। গ্রামবাসীরা বলছেন, তাঁরা একটা গাছও কাটতে দেবেন না। দিলীপ সাহু বলেন, ‘‘যদি প্রশাসন আমাদের উপর জোর খাটায়, তাহলে আর একটা কলিঙ্গনগর দেখতে হবে। কারণ গোটা ব্যাপারটাই বেআইনি।” তিনি এই কথাও জানালেন, যখন উপকূল সংলগ্ন জেলা জয়পুরে টাটা স্টিল লিমিটেডকে স্টিল প্ল্যান্টের জন্য জমি দিতে সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছিল, তখন ২০০৬ সালে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন আদিবাসী মারা গিয়েছিলেন। সেই সময়ও প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন তাঁরা।

বনাধিকার আইন বলছে, বন সাফাই অর্থাৎ বনভূমিকে বন-অতিরিক্ত বা বনস্ম্পর্কিত নয়, এমন কোনও কাজের জন্য রূপান্তরিত করার আগে কিছু বিধিনিয়ম মানতে হয়। প্রথমত, ওই বনভূমিতে যে গ্রামগুলি রয়েছে, তারা গ্রামসভা করবে, সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হবে ওই বনভূমি রূপান্তর হবে কিনা। তাদেরকে সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনও ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত বনাধিকারের দাবি বকেয়া থাকবে না।

পাত্রপালি গ্রামের সরপঞ্চ এবং বনাধিকার কমিটির প্রেসিডেন্ট সংযুক্তা সাহু বললেন, যে গ্রামসভার সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক খনিকে বন সাফাইয়ের অনুমোদন দিয়েছে, সেগুলি আদতে জাল নথি। আমাদের দেখানোর জন্য গ্রামসভার রেজিস্টারটি বের করে এনে তিনি বললেন, ‘‘আমাদের গ্রাম কয়লা খনির জন্য ৭০০ হেক্টর জমি হস্তান্তর করার ব্যাপারে কোনও সম্মতিই দেননি। কোনও ভাবেই না। অন্যদিকে, ২০১২ সালে আমরা বনাধিকার আইনের অধীনে, ৭১৫ একর জমির জন্য কমিউনিটি ফরেস্ট রাইটস দায়ের করেছিলাম। প্রশাসন সাতবছর ধরে আমাদের দাবিগুলি চেপে রেখেছে, আর এখন আমরা জানতে পারলাম, কোম্পানি আমার বনের বরাত পেয়েছে। এটা ঠিক কেমন করে হয়, বলুন তো?”

পাত্রপালির দিলীপ সাহু জানাচ্ছেন, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে সম্বলপুর জেলায় হীরাকুদ বাঁধের জন্য যেসকল পরিবার উচ্ছেদ হয়েছিল, তার মধ্যে ২০০টি পরিবার এই গ্রামগুলিতেই থাকেন। ‘‘যদি বনভূমি কয়লাখনিকে দেওয়া হয়, আবার আমাদের উদ্বাস্তু হতে হবে। আমরা বুঝি সারাটা জীবন উচ্ছেদের মধ্যেই কাটাব, বাঁধ, আর খনির চক্করে?”

Left: The villagers say income from forest produce helped them build this high school in the village. Right: In a large clearing, under the watch of company staff, hundreds of freshly logged trees are piled up
PHOTO • Chitrangada Choudhury
Left: The villagers say income from forest produce helped them build this high school in the village. Right: In a large clearing, under the watch of company staff, hundreds of freshly logged trees are piled up
PHOTO • Chitrangada Choudhury

বাঁদিকে: গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, বনজ দ্রব্য থেকে যা রোজগার হয়, তা দিয়েই তাঁরা গ্রামে এই হাইস্কুলটি তৈরি করতে পেরেছেন। ডানদিকে: কোম্পানির কর্মীদের নজরদারিতে বিশাল সংখ্যায় কাটাইয়ের পরে শত শত সদ্য কাটা গাছ স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে

তালাবিরা গ্রামের বাসিন্দাদের আরেকটি অভিযোগ এই যে, তাঁদের গ্রামের গ্রামসভার সম্মতির সিদ্ধান্তটি জাল, জঙ্গল কেটে সাফাই করার জন্য তা নকল করা হয়েছে। তাঁরা রাজ্য সরকারের নানান কর্তৃপক্ষকে অক্টোবরে পাঠানো তাঁদের লিখিত অভিযোগ দেখালেন। ওয়ার্ড সদস্য সুষমা পাত্র বলেন, ‘‘সব কিছু জাল করে করা হয়েছে। আমরা গাছ কাটার জন্য কোনও সম্মতি দিইনি।” রাউত আরও বললেন, ‘‘বরং আমাদের তালাবিরা গ্রাম্য জঙ্গল কমিটি থেকে ২০১২ সালের ২৮শে মে কালেক্টরকে লিখিতভাবে আবেদন করেছিলাম, যাতে বনাধিকার আইনের আওতায় আমাদের বনের আইনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে জালিয়াতি বিষয়ে লিখিত অভিযোগের সঙ্গেই আমরা সেটারও একটি প্রতিলিপি পাঠিয়েছি।”

নিউ দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র রিসার্চার কাঞ্চি কোহলি তালাবিরার বন সাফাইয়ের নথিটি পড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণভাবে বনাঞ্চল রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি ভয়ানক অস্বচ্ছ। [প্রকল্পের] অনুমোদনের জন্য গৃহীত সুপারিশ তথা রিপোর্টগুলি খুঁটিয়ে দেখার কোনও সুযোগই তো নেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের। তালাবিরার ঘটনা থেকেই তা প্রতিফলিত হয়। অবশেষে যখন গাছ কাটার অভিযান শুরু হল, একমাত্র তখনই গ্রামবাসীরা আন্দাজ করতে পেরেছেন এই বনাঞ্চল, যেটির উপর তাঁদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রয়েছে, সেখানে খনি সম্প্রসারণের কাজটা কতখানি ব্যাপক আকারে হচ্ছে!”

কোহলি জানালেন, নথিটা পড়লেই, ‘‘পরিষ্কার বোঝা যায়, এলাকা পর্যবেক্ষাণের কাজটি ভালো করে হয়নি, মূল্যায়নও খাপছাড়া হয়েছে। ১.৩ লক্ষ গাছ কাটার প্রভাব নগণ্য বলে নথিবদ্ধ করা হয়েছে, কোনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। গ্রামসভার সিদ্ধান্তগুলিও পরিবেশমন্ত্রকের বন উপদেষ্টা কমিটির দ্বারা পরীক্ষিত হয়নি। সব থেকে বড়ো কথা হল, বনাঞ্চলের রূপান্তরের প্রক্রিয়াটির মধ্যে একটা বিরাট আইনি ফাঁক রয়েছে।”

রঞ্জন পণ্ডার সংযোজন, কর্তৃপক্ষকে গ্রামবাসীদের প্রতিবাদে কর্ণপাত করতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘কয়লা হল পরিবেশ তথা জলবায়ুর সব থেকে বড়ো শত্রু, এবং গোটা পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মেটাতে কয়লাজনিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসতে চাইছে।”

দিলীপ সাহু বলছেন, ‘‘গ্রামের মানুষদের মধ্যে বনাধিকার আইন জনপ্রিয় করার জন্য সরকার কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমরা নিজেদের চেষ্টায় দাবিগুলি দায়ের করেছি। যখন কোনও আইন ছিল না, তখন থেকে আমরা বন রক্ষা করে চলেছি। আর আজ সরকার দাবি করছে, আমরা গ্রামবাসীরা নাকি আমাদের বন কোম্পানির হাতে তুলে দিতে সম্মত হয়েছি! তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, যদি আমাদের সম্মতি থেকেই থাকে, তাহলে কোম্পানির দরকারে গাছ কাটার জন্য আমাদের গ্রামে এত পুলিশ মোতায়েন করতে হচ্ছে কেন?”

সংযোজন: আদানি এন্টারপ্রাইজ জানিয়েছে যে তাদের তত্ত্বাবধানে তালাবিরা কয়লা খনি অঞ্চলে কোনও গাছ কাটা হয়নি। এই অবস্থানকে প্রতিফলিত করার জন্য ৯ই জানুয়ারি, ২০২০ তারিখে উপরের নিবন্ধটি হালনাগাদ করা হয়েছে।

অনুবাদ: রূপসা

Chitrangada Choudhury
suarukh@gmail.com

Chitrangada Choudhury is an independent journalist, and a member of the core group of the People’s Archive of Rural India.

Other stories by Chitrangada Choudhury
Translator : Rupsa
rupsaray2009@gmail.com

Rupsa is a journalist in Kolkata. She is interested in issues related to labour, migration and communalism. She loves reading and travelling.

Other stories by Rupsa