খুব কাঁদছিলেন নসুমুদ্দিন। এই প্রথম বাড়ি থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে যাচ্ছেন তিনি, বাবা-মাকে ছেড়ে। সাত বছর বয়সে সেটা খুব কঠিন ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘খুব কষ্ট হচ্ছিল, আমি কাঁদছিলাম। বাড়ি, পরিবার ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে বুকটা ভেঙে যচ্ছিল।”
নসুমুদ্দিনকে পাঠানো হচ্ছিল রাখালের কাজ করতে। “আমাদের পরিবার খুবই গরিব, বাপ-মার কাছে অন্য কোনও পথ ছিল না যে,” বলছিলেন জীবনের ৪১টা বছর পার করা নসুমউদ্দিন শেখ। “পেট ভরে দুবেলা খাবারটুকুও জুটতো না আমাদের। বেশিরভাগ দিনই কোনওমতে একবেলা খেতাম, যা কিছু এদিকওদিক শাকপাতা পেতাম আর কি। আমাদের গ্রামে খুব কম লোকই তখন দিনে দুইবেলা পেটের খাবার জোটানোর ক্ষমতা ধরত। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাদীক্ষার কথা ছিল কল্পনাতীত: "তখন স্কুলে যাওয়ার কথা ভাবার অবস্থাই ছিল না। পরিবারের যে ভয়ানক দুরবস্থা ছিল, তাতে স্কুলে পড়ার সামর্থ্য হতই বা কেমন করে?”
ফলে আসামের ধুবড়ি জেলার উড়ারভুই গ্রামের খড়ে ছাওয়া কুঁড়েঘরটি ছেড়ে তিনি রওনা দিলেন মানুল্লাপাড়া গ্রামে। টিকিটের দাম ৩ টাকা। কাজে নিয়োগ করার কথা যাঁর, সেই মালিকের ১২ বিঘা জমি আর ৭টি গরু আছে। নসুমুদ্দিন বলছেন, “রাখালের জীবন খুব কষ্টের। ওই বয়সে লম্বা সময় কাজ করতে হত। প্রায়শই পেট ভরে খাবার মিলত না, জুটত বাসি খাবার। আমি খিদেয় কাঁদতাম। প্রথম প্রথম আমাকে শুধু খাবারটুকুই দেওয়া হত, একটা ঘুমোনোর জায়গা ছিল। এর বাইরে কোনও টাকাপয়সার ব্যাপার ছিল না। আমার মালিক বছরে ১০০-১২০ মণ চাল পেত। বছর দুয়েক কাজ করার পর আমাকে তারা ২ মণ চাল দিতে শুরু করল”— অর্থাৎ প্রায় ৮০ কিলো, মার্চ থেকে নভেম্বরের চাষের মরসুমের শেষে।
কয়েক দশক আগেও আসাম-মেঘালয়ের সীমান্ত এলাকায় ছোটো ছেলেদের রাখাল হিসেবে কাজে পাঠানোটাই ছিল দস্তুর। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বড়ো চাষিদের কাছে ‘দিয়ে দেবেন’ তাঁদের বাবা-মায়েরা, যেখানে গবাদিপশুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে তাদের নিয়োগ করা হবে। স্থানীয় ভাষায় এই ব্যবস্থাকে ‘পেটভাত্তি’ বলা হয় (আক্ষরিক অর্থ ভাত দিয়ে পেট ভরা)।

ভোর হওয়ার আগেই নসুমুদ্দিন কড়কড়ে জিলিপি ভাজতে আরম্ভ করেন। রাখাল জীবনের কথা মনে করে বলেন তিনি, ‘সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, রাতে যদি পেট ভরে খেতে না দেয়, বা বাসি খাবার দেয়, কেমন লাগবে? আমার বড্ডো অসহায় লাগত’
নসুমুদ্দিনের ছোটো দুই ভাইকেও রাখাল হিসেবে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল, তবে সেটা অবশ্য তাঁদের নিজেদের গ্রাম উড়ারভুইতেই। তাঁর বাবা হুসেন আলি (গতমাসে ৮০ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন) ভূমিহীন কৃষক ছিলেন, ফসল ভাগের বন্দোবস্তে ৭-৮ বিঘা লিজে নেওয়া জমি চাষ করতেন। (তাঁর মা নসিরন খাতুন, গৃহস্থালি সামলাতেন, ২০১৮ সালে তিনি মারা গেছেন।)
নসুমুদ্দিন ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। রাখাল হিসেবে কাজের পর্বে ভোর চারটেয় দিন শুরু হত। তিনি বলছেন, “সকালের নামাজের সময়ে উঠে পড়তাম।” তারপরে খড় ভিজিয়ে সর্ষের খোলে মিশিয়ে গরুর খাবার তৈরি, গোয়াল পরিষ্কার ইত্যাদি সেরে মালিকের ভাইদের সঙ্গে ধান খেতে গরু চরাতে যেতেন। সেখানে তিনি ঘাস পরিষ্কার করতেন, গরুকে জল দিতেন, অন্যান্য কাজগুলিও করতেন। সকালের খাবার মাঠেই পাঠানো হত। চাষের মরসুমে কখনও কখনও মাঠেও কাজ করতে হত। বলছেন তিনি, “সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, রাতে যদি যথেষ্ট খেতে না দেওয়া হয়, বা বাসি খাবার দেওয়া হয়, কেমন লাগবে? আমার অসহায় লাগত।”
মাঝেমধ্যেই সারারাত কাঁদতেন। শুতেন পুরোনো কাপড়ে তৈরি বালিশ আর বাঁশের তক্তার উপর খড় বিছিয়ে।
প্রতি দু’তিন মাস অন্তর তাঁর বাড়ি যাওয়ার অনুমতি মিলত। “দু-তিনদিন থাকতাম, বাড়ি ছেড়ে আসতে খুব খারাপ লাগত।”
নসুমুদ্দিনের বয়স যখন ১৫, তখন তাঁর বাবা অন্য আর এক ব্যবসায়ী চাষির কাছে ছেলেকে কাজে পাঠালেন। মনুল্লাপাড়া গ্রামে তাঁর ৩০-৩৫ বিঘা জমি ছিল, কাপড়ের দোকান-সহ অন্যান্য নানা ব্যবসা ছিল। “যখন ফের আমাকে নতুন জায়গায় যেতে হল, আমার বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছিল। আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। সোধা ব্যাপারী (নতুন নিয়োগকর্তা) আমাকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন, দু’টাকা উপহার দেন। আমি পরে তা দিয়ে চকোলেট কিনেছিলাম, মনে আছে এটা করে খুব খুশি হয়েছিলাম। কয়েকদিন বাদে আমার আগের তুলনায় একটু ভালো লাগতে আরম্ভ করল, তখন নতুন বাড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করলাম।”
আবারও শুরু হল সেই এক জীবন। খাবার, গোয়ালে ঘুম, চাষের মরসুমের পরে দু’ বস্তা চাল, নগদ ৪০০ টাকা — সর্বসাকুল্যে এই হল বাৎসরিক বেতন প্যাকেজ। সারাদিনের কাজের মধ্যে ছিল গরুকে খাওয়ানো, গোয়াল পরিষ্কার করা। কিন্তু জীবনটা নসুমুদ্দিনের জন্য একটু ভদ্র হল। এখন তাঁর বয়স ১৫, কাজেই আর একটু পোক্তভাবে কাজ করতে পারেন। তার থেকেও বড়ো কথা, নিয়োগকর্তার শরীরে দয়া ছিল — জানালেন তিনি।


দু’দশক আগে বিয়ের সূত্রে তিনি তাঁর স্ত্রী বালি খাতুনের পরিবারের থেকে মিষ্টি তৈরির কৌশল শেখার সুযোগ পে য়েছিলেন
এই বাড়িতে খাবার হল গরম ভাত, সবজি, মাছ বা মাংসের ঝোল — আগের নিয়োগকর্তার বাড়ির মতো পান্তা ভাত নয়। “আমি তাঁদের সঙ্গে বাজারে গেলে আমাকে রসগোল্লা খাওয়াত। ঈদে নতুন জামা হত। আমার নিজেকে ওদের পরিবারের একজন বলেই মনে হত।”
কিন্তু তাঁর বাবার ছিল অন্য ফিকির। দু’বছর বাদে, তাঁর যখন বয়স ১৭, তখন তাঁকে পাঠানো হল আর একটা বাড়িতে কাজ করতে। এ বারও অবশ্য তাঁদেরই গ্রাম উড়ারভুইতে। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তাঁকে বছরে ১৫০০ টাকা ও চাষের মরসুমের পর একই পরিমাণ চালের বিনিময়ে কাজে নিলেন।
এই করে আরও একটা বছর চলে গেল।
তাঁর কথায়, “আমি প্রায়ই ভাবতাম, গোটা জীবনটা কি দাসত্বই করে কাটাবো! কিন্তু আমার তো অন্য উপায়ও ছিল না।” কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি, নিজের মতো করে কিছু কাজ করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন নব্বইয়ের দশকে তাঁর গ্রাম থেকে অন্যত্র কাজে চলে যাচ্ছে যুবকরা। এলাকায় সরকারি প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ বাড়ছে। ছোটো ছোটো ছেলেরা আর রাখালির কাজ করতে চাইছে না। বরং শহরে, মফস্সলে চায়ের দোকান দিয়ে মাসে ৩০০-৫০০ টাকা আয় করছে, এবং বাড়ি ফিরছে ‘বড়ো’ টাকা নিয়ে।
তাদেরকে আনকোরা রেডিয়ো শুনতে দেখে, ঝকঝকে ঘড়ি পরতে দেখে নসুমুদ্দিনেরও মন আনচান করত। কেউ কেউ বাইসাইকেলও কিনেছিল। তিনি বলছেন, “ওরা অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো লম্বা প্যান্ট পরত। আমি ওদের নানা কথা জিজ্ঞেস করতাম, বোঝার চেষ্টা করতাম যে, ওরা কী করে। কেমনভাবে চালায়। আর তারপর ঠিক করলাম আমিও ওদের সঙ্গে যাব।”
নিজের গ্রাম থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে মেঘালয়ের বাঘমারা শহরে তিনি কাজের খোঁজ পেলেন। গোপনে খবর নিলেন যাবেন কেমন করে, তারপর সেই নিয়ে পরিকল্পনা করলেন। “আমার চিন্তা হচ্ছিল, কিন্তু বাড়িতে কিছু জানাইনি, যদি পরিবারের লোকেরা আমার পিছু ধাওয়া করে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।”
একদিন সকালে গরু চরাতে নিয়ে যাওয়ার বদলে ছুটতে শুরু করলেন নসুমুদ্দিন। “যে ছেলেগুলোর সঙ্গে বাইরে কাজের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম, তাদের একজনের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। আমরা হাতসিঙ্গিমারি শহরের বাস স্টপ অবধি ছুটেছিলাম। আমি কিছু খাইনি। ১৭ টাকার টিকিটের পয়সাটুকুও ছিল না। বাঘমারা পৌঁছে আমার গ্রামের আর এক ছেলের কাছ থেকে ধার করেছিলাম।”
নসুমুদ্দিনের কথায়, ‘আমি প্রায়ই ভাবতাম, গোটা জীবনটা কি দাসত্ব করেই কাটাবো! কিন্তু আমার তো অন্য উপায়ও ছিল না। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি— নিজের মতো করে কিছু একটা কাজ করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন
খালি পেট, শূন্য পকেটে তিনি পৌঁছলেন তাঁর স্বপ্নের গন্তব্যে। বাস থেকে নামলেন রমণী চায়ের দোকানের সামনে। ক্ষুধার্ত চোখে এই একা একটা ছেলেকে দেখে চায়ের দোকানের মালিক হাত নেড়ে ভিতরে আসতে বললেন। খাবার আর থাকার জায়গার বন্দোবস্ত হল, কাপডিশ ধোওয়ার কাজও মিলল।
চোখের জলে কাটল তাঁর প্রথম রাত। গ্রামের মালিকের কাছে মাইনে বাবদ বকেয়া ১০০০ টাকার কথা ভেবে তিনি কেঁদে ফেললেন। তখন এটাই তাঁর উদ্বেগের একমাত্র কারণ ছিল। “আমার খুব খারাপ লাগছিল। গতরে খেটে আয় করা আমার অতগুলো টাকা এভাবে নষ্ট হল।”
মাসের পর মাস যায়। চায়ের কাপ-প্লেট পরিষ্কার করতে শিখে গেছেন তিনি, শিখেছেন টেবিলে সাজাতেও। গনগনে ধোঁয়া ওঠা চা বানাতেও দিব্যি শিখে গেলেন। তাঁর মাস মাইনে তখন ৫০০ টাকা, সবটাই জমা করেন তিনি। “এইভাবে যখন ১৫০০ টাকা হল, আমার মনে হল এইবার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা উচিত। আমি জানতাম, এই টাকাটা তাদের জন্য বড়ো সহায় হবে। বাড়ি ফেরার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম।”
বাড়ি ফিরে জমানো টাকার সবটাই বাবাকে দিয়ে দিলেন। বহুদিনের একটা পারিবারিক দেনা শোধ হল সেই টাকা দিয়ে। তাঁর কথায়, বাড়ি থেকে পালানোর জন্য শেষমেশ তাঁর পরিবার তাঁকে মাফ করে দিল।
একমাস বাদে নসুমুদ্দিন বাঘমারায় ফিরলেন, অন্য একটা চায়ের দোকানে কাপ-প্লেট ধোওয়া, পরিষ্কার করার কাজ পেলেন, এবার মাসে ১০০০ টাকায়। দ্রুত পদোন্নতি হলো ওয়েটারের ভূমিকায় — খরিদ্দার এলে চা, মিষ্টি, পুরি-সবজি, পরোটা, সামোসা, রসমালাই, রসগোল্লা ইত্যাদি জলখাবার পরিবেশন করেন — ভোর চারটে থেকে সন্ধে আটটা অবধি কাজ। সমস্ত ওয়েটার-কর্মীরাই রাতে দোকানে ঘুমোন।
এখানে তিনি প্রায় চার বছর কাজ করলেন, নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠান তখন। যখন হাতে ৪ হাজার টাকা জমা হল, ফিরে এলেন বাড়িতে।
নিজের টাকায় একটা ষাঁড় কিনলেন, তাই দিয়েই নিজেদের জমি চষতে লাগলেন। গ্রামে কাজ বলতে তখন একমাত্র সেটাই। জমিতে হাল দেওয়া, বীজ বোনা, জমি পরিষ্কার করা – এই নিয়ে মাঠেই ব্যস্ত থাকতেন সারাটা দিন।


সাধারণত বিকেল বা সন্ধে নাগাদ নসুমুদ্দিন রসগোলা বানাতেন – তারপর সেটাকে রেখে দিতেন। কিন্তু লকডাউন শুরু হতেই তাঁর এই ছোট্ট (এবং মিষ্টি) জগতটাও থমকে দাঁড়াল
একদিন সকালে তিনি যখন মাঠের কাজে ব্যস্ত, তখন একদল হালোই (হালুইকর, মিষ্টি প্রস্তুতকারক) পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। “আমি জিজ্ঞেস করলাম বড়ো অ্যালুমিনিয়ামের ডিশে কী নিয়ে যাচ্ছে। তারা বলল, এগুলো রসগোল্লা। আমি জানলাম, এটা বেশ লাভজনক ব্যবসা। এবার আমার অনুতাপ হতে লাগল, আমি এমন চায়ের দোকানেও কাজ করেছি যেখানে রসগোল্লা তৈরি হত, কিন্তু কেমনভাবে বানাতে হয়, কেন যে কখনও শিখিনি।”
নসুমুদ্দিন সেই সময়ে সংসার করে থিতুও হতে চাইছিলেন। “আমার বয়সী ছেলেরা (কুড়ির কোঠার প্রথম দিকে) তখন বিয়ে করে ফেলছে। কেউ বা প্রেম করছে। আমারও মনে হচ্ছিল, নিজের একজন জীবনসঙ্গী চাই বৈকি। একটা বাড়ি চাই, যেখানে সন্তানদের সঙ্গে সুখে থাকব।” এক চাষির জমিতে জল সেচতে আসতেন এক তরুণী, তাঁকে বেশ মনে ধরে নসুমুদ্দিনের। সবুজ ধানখেতের মধ্যে তাঁকে কাজ করতে দেখতেন চেয়ে চেয়ে। অতপর একদিন সাহস করে বলেই বললেন। একেবারে যাচ্ছেতাই ফল হল! তিনি ছুট্টে পালালেন, পরের দিন থেকে কাজে আসাও বন্ধ দিলেন।
“আমি বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করলাম, সে যদি আবার আসে। কিন্তু আর কখনও তাকে দেখিনি”- রোমন্থন করেন নসুমুদ্দিন। “তখন আমি আমার জামাইবাবুর কাছে কথাটা পাড়লাম, সে আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করল।” তাঁর বিয়ে ঠিক হল কাছের গ্রামেই এক হালোইয়ের কন্যা বালি খাতুনের সঙ্গে, এখন তাঁর বয়স প্রায় ৩৫। (পরে তিনি জানতে পেরেছিলেন যাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তিনি তাঁরই স্ত্রীর কাকিমা!)
বিয়ের সূত্রেই তাঁর স্ত্রীর পরিবারের কাছ থেকে মিষ্টি বানাতে শেখার সুযোগ এল। তাঁর প্রথম স্বাধীন প্রয়াস শুরু হল তিন লিটার দুধ দিয়ে — ১০০টা রসগোল্লা বানিয়েছিলেন, বাড়ি বাড়ি ফেরি করে প্রতিটা এক টাকায় বিক্রি করেছিলেন, ৫০ টাকা লাভ ছিল।
এটাই উপার্জনের নিয়মিত উৎস হয়ে দাঁড়াল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাধ্যমেই তিনি পরিবারের বেশ খানিকটা ধার শোধ করলেন, খরা-বন্যায় চাষের ক্ষতি যা হয়েছে, সেগুলো পূরণ করতে পারলেন।


‘আমি কাছকাছি গ্রামগুলোতে হেঁটে মিষ্টি বিক্রি করতে যাই। ২০-২৫ কিলো মিষ্টি নিয়ে ২০-২৫ কিলোমিটার হাঁটি’
২০০৫ সালে নসুমুদ্দিনের বয়স তখন ২৫, গেলেন মহেন্দ্রগঞ্জে। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মেঘালয়ের ওয়েস্ট গারো হিলস জেলার সীমান্ত শহরে। তিনি শুনেছিলেন ওখানে মিষ্টির ব্যবসায় লাভ আছে। কিন্তু শহরে একেবারে আগন্তুক তিনি, সহজ হল না তাঁর পক্ষে। সেই সময়ে ওখানে পরপর ডাকাতির কারণে সুরক্ষা ঘিরেও সমস্যা তৈরি হয়েছিল। লোকে চিন্তিত ছিল। তিনমাস লেগেছিল নসুমুদ্দিনের একটা জায়গা ভাড়ার আস্তানা জোটাতে। এবং তারপরে তাঁর মিষ্টির ক্রেতা তৈরি করতে আরও তিনটে বছর সময় লেগেছিল।
তাঁর পুঁজি ছিল না, ব্যবসা শুরু করেন ধারে। সব মাল নিয়েছিলেন ধারে। তাঁর স্ত্রী বালি খাতুন ২০১৫ সালে মহেন্দ্রগঞ্জ চলে আসেন। তাঁদের তিন সন্তান। বড়ো মেয়ে রাজমিনা খাতুনের বয়স এখন ১৮। আর দুই ছেলে ফরিদুল ইসলাম ও সরিফুল ইসলামের বয়স এখন ১৭ আর ১১। দু’জনেই এখন স্কুলে পড়ে।
গত কয়েক বছর ধরে নসুমুদ্দিনের মাস গেলে লাভ থাকছিল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। ব্যবসা প্রসারিতও হয়েছে। রসগোল্লার সঙ্গে তিনি ও বালি খাতুন জিলিপিও বানাতে শুরু করেছিলেন।
মরসুম কেমন যাচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে নসুমুদ্দিন সপ্তাহে ৬ দিন বা ৭ দিন ব্যবসা করেন। তিনি ও বালি খাতুন সাধারণত বিকেল বা সন্ধেয় রসগোল্লা বানান — ১০০টা রসগোল্লার জন্য লাগে ৫ লিটার দুধ আর দুই কিলো চিনি। এই রসগোল্লা রাখা থাকে বিক্রির জন্য। আর ভোর হওয়ার আগেই শুরু করেন জিলিপি বানানো, যেগুলো কড়কড়ে থাকতে থাকতেই বিক্রি হবে। তারপর নসুমুদ্দিন বেরোন দুটো জিনিস নিয়েই, বাড়িতে বাড়িতে, গ্রামের চায়ের দোকানগুলিতে বিক্রি করেন। দুপুর দুটোর মধ্যে ফিরে আসেন।
তাঁর ছোট্টো (এবং মিষ্টি) জগৎটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, যখন ২০২০ সালের মার্চে কোভিড ১৯-এর কারণে শুরু হল দেশজোড়া লকডাউন। পরের কয়েকটা সপ্তাহ খুব কষ্টে কেটেছে গোটা পরিবারের। চাল-ডাল, শুঁটকি মাছ আর লাল লঙ্কার গুঁড়ো যা জমানো ছিল, তাই দিয়েই অন্নসংস্থান হয়েছে। তাঁদের বাড়িওয়ালা পরে চাল, সবজি দিয়ে সাহায্য করেছেন। (যেহেতু নসুমুদ্দিন একজন পরিযায়ী শ্রমিক, তাই তিনি সরকারি ত্রাণের জন্য মহেন্দ্রগঞ্জে তাঁর রেশন কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না।)
দিন কয়েক বাদে অবশেষে তিনি রসগোল্লা বিক্রি করতে পারলেন সেসব প্রতিবেশীদের কাছে যাঁরা বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিলেন। এতে তাঁর রোজগার হল ৮০০ টাকা। এছাড়া তাঁর আর কোনও রোজগার তখন ছিল না।


অতিমা রির সময়ে নসুমুদ্দিনের রোজগার অনিয়মিত হয়ে পড়েছে: ‘জীবন কঠিন হয়ে গেছে। অবশ্য তা আমার শৈশবের মতো অতখানি কঠিন নয়...’
লকডাউনের পর একমাস কাটল। একদিন বিকেলে তাঁর বাড়িওয়ালা জিলিপি খেতে চাইলেন। যা কিছু জোগাড় যন্তর করতে পালেন তা দিয়েই নসুমুদ্দিন জিলিপি বানালেন। এবার প্রতিবেশীরাও জিলিপির আবদার করতে লাগলেন। ধারে নসুমুদ্দিন কিছু ময়দা, চিনি, পাম অয়েল কিনলেন কাছের একটি পাইকারি মুদির দোকান থেকে। প্রতি বিকেলে জিলিপি বানানো শুরু করলেন, দৈনিক তাঁর ৪০০-৫০০ টাকা আয় হতে লাগল।
এপ্রিলে যখন রমজান শুরু হল, তখন জিলিপির চাহিদা আরও বেড়ে গেলে। পুলিশের কড়া পাহারা সত্ত্বেও সপ্তাহে এক-দু’বার তিনি গ্রামে জিলিপি বিক্রি করতে পেরেছিলেন- সব সময়ে স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, মাস্ক পরেই এই কাজ করেছেন তিনি সেকথাও জানালেন। এইভাবে ধার মিটল, লকডাউনের শুরুতে যে লোকসান হয়েছিল তাকেও খানিক সামাল দেওয়া গেল।
লকডাউন শিখিল হলে আবার শুরু করলেন তাঁর জিলিপি ও রসগোল্লার নিয়মিত ব্যবসা। তবে, তাঁর কথায়, তাঁর আয়ের বেশিরভাগটাইও খরচ হয়েছে তাঁর বাবা, স্ত্রী ও মেয়ের চিকিৎসায়। কোনও গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকলেও হাজারটা রোগজ্বালা লেগেই রয়েছে।
২০২০ সালের শেষের দিকে নসুমুদ্দিন আসামে তাঁর নিজের গ্রাম উড়ারভুইয়ে নিজের বাড়ি বানানো শুরু করেন। এ বাবদও তাঁর সঞ্চয় থেকে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়েছে।
তারপর আবার ২০২১-এ লকডাউন শুরু হল। সেই সঙ্গে তাঁর বাবার শরীরটাও খারাপ হল (জুলাই মাসে প্রয়াত হয়েছেন)। তাঁর ব্যবসাতেও তেমন গতি নেই। তিনি বলছিলেন, “এই অতিমারির সময়ে আমার কোনও নিয়মিত রোজগার নেই। আমি কাছের গ্রামগুলোতে হেঁটে মিষ্টি বিক্রি করতে যাই, প্রায়শই ২০-২৫ কিলো মিষ্টি নিয়ে ২০-২৫ কিলোমিটার হাঁটি। সপ্তাহে ৬-৭ দিনের বদলে এখন সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্যবসা করি। বড্ডো ক্লান্ত লাগে। জীবন এই সময়ে খুব কঠিন হয়ে গেছে। তবে আমার শৈশবের মতো অতটাও কঠিন নয়। ওই দিনগুলোর কথা ভাবলে আমার আজও কান্না পায়।”
প্রতিবেদকের সংযোজন: নসুমুদ্দিন শেখ তাঁর পরিবার নিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জে আমার বাবা-মায়ের পুরনো বাড়িতে ২০১৫ সাল থেকে ভাড়া থাকছেন। সদা হাস্যময় এই মানুষটি আমার বাবা-মাকে সাহায্য করেন, মাঝেমধ্যে আমাদের রসুই-বাগিচার দেখভালও করেন।
অনুবাদ : রূপসা