“টিকরি সীমান্তে রাস্তার দুধারেই ৫০ কিলোমিটার লম্বা ট্রাক্টরের লাইন,” জানালেন কমল ব্রার। তিনি ২০ জন চাষির সঙ্গে হরিয়ানার ফতেহাবাদ জেলায় তাঁদের গ্রাম থেকে ৫টি ট্রাক্টর ও ২টি ট্রলি নিয়ে ২৪শে জানুয়ারি এসে পৌঁছেছিলেন টিকরিতে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদে পাশ হওয়া তিনটি কৃষি-আইনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার প্রতিবাদী কৃষক দেশের রাজধানীর ঠিক বাইরে যে তিনটি জায়গায় জড়ো হয়েছেন, তার মধ্যে হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তে অবস্থিত টিকরি অন্যতম।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁরা দিল্লির রাজপথে একটি অভূতপূর্ব ট্রাক্টর কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছেন।
আরও অনেকের সঙ্গে এই কুচকাওয়াজে যোগ দিতে চলেছেন নির্মল সিং। পঞ্জাবের ফাজিলকা জেলার আবোহার ব্লকের ওয়াহাবওয়ালা গ্রামের মানুষ তিনি। নির্মল সহ ২৫ জন গ্রামবাসী এসেছেন কিষান মজদুর একতা ইউনিয়নের ঝান্ডা ধরে, তবে টিকরি পৌঁছে তাঁদের ৪টি ট্রাক্টর যে কোথায় দাঁড় করাবেন, সেটা খুঁজে পেতেই কাবার হয়ে গিয়েছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা। “কাতারে কাতারে লোক আসছে। ট্রাক্টরের সংখ্যা বিশাল পরিমাণে বাড়বে, কথাটা মিলিয়ে নেবেন,” বললেন তিনি।



বাঁদিকে: প্রজাতন্ত্র দিবসের ট্রাক্টর-কুচকাওয়াজের জন্য বন্দোবস্ত করছেন হরিয়ানার সুরেওয়ালা গ্রামের মহিলারা। মাঝখানে: প্রধান মঞ্চে চলছে বক্তৃতার পালা, মন দিয়ে শুনছেন চাষিরা। ডানদিকে: রাজ কৌর বিবি (টিকরি সীমান্তে তাঁর বৌমার সঙ্গে) জানালেন, ‘মহিলাদের ক্ষমতা যে কতখানি, ২৬শে জানুয়ারি সেটা সরকার নিজের চোখে দেখুক’
“কুচকাওয়াজের দিন, প্রতিটা ট্রাক্টরে দশজন করে চাপতে পারবে। র্যালিটা শান্তিপূর্ণ হবেই, পুলিশ যে রাস্তাটা বেঁধে দিয়েছে, আমরা সেটার থেকে এক-পাও নড়ব না। কুচকাওয়াজের সময় যদিই কোনও দুর্ঘটনা বা ঝুট-ঝামেলা ঘটে, সেসব সামলানোর জন্য কৃষক-নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী দলকে দল স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে,” বললেন কমল ব্রার।
ট্রাক্টরের সারি একবার রওনা দিলে মাঝরাস্তায় খাবারদাবারের কোনও বন্দোবস্ত নেই, তাই কুচকাওয়াজের আগেই চাষিদের হাতে হাতে চা-জলখাবার তুলে দেবে লঙ্গরগুলি (যৌথ হেঁশেল)।
সমাবেশের পরিচালনায় থাকবেন মহিলা চাষিরা, ইতিমধ্যেই কুচকাওয়াজের তোড়জোড়ে লেগে গেছেন তাঁরা — ২৬শে জানুয়ারির কথা মাথায় রেখে টিকরির রাস্তায় দলে দলে মহিলারা ট্রাক্টর চালিয়ে হাত পাকিয়ে নিচ্ছেন।
এক্কেবারে অগ্রভাগে যে মহিলারা নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হরিয়ানার ফতেহাবাদ জেলার জাখাল ব্লকের রাজ কৌর বিবি (৬৫)। পেশায় চাষি এই মানুষটি বললেন, “মহিলাদের ক্ষমতা যে কতখানি, সেটা সরকার নিজের চোখে দেখবে [জানুয়ারির] ২৬ তারিখ।”
২৪শে জানুয়ারির রাতে ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের (একতা উগ্রহণ) নেতৃত্বে প্রায় ২০,০০০ ট্রাক্টরের একটি কাফিলা এসে পৌঁছয় টিকরি সীমান্তে। পঞ্জাবের ভাটিন্ডা জেলার ডাবওয়ালি এবং সাঙ্গরুর জেলার খানৌরি সীমান্ত হয়ে এসেছিলেন চাষিরা।


বাঁদিকে: ভাটিন্ডা থেকে ট্রাকের একটি কাফিলা এসে পৌঁছেছে টিকরি সীমান্তে। ডানদিকে: ট্রাক্টর-কুচকাওয়াজের জন্য তৈরি হচ্ছেন দালাল খাপের পুরুষেরা
ট্রাক্টর নিয়ে অপেক্ষারত চাষিদের মধ্যে ৬০ বছর বয়সি জাসকরন সিংও রয়েছেন, পঞ্জাবের মানসা জেলার শের খানওয়ালা গ্রামের এই মানুষটি জনাকয় কৃষকের সঙ্গে ৫টি ট্রাক্টর নিয়ে প্রথমবার টিকরিতে আসেন ২৭শে নভেম্বর। তাঁর কথায়: “সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এখানে বসে আছি, কোত্থাও কোনও অভব্য আচরণ, চুরি-টুরি কিংবা উচ্ছৃঙ্খলতার ঘটনা ঘটেনি।”
মানসা জেলায় তার গ্রাম থেকে টিকরিতে আসা-যাওয়া লেগেই আছে তাঁর। ২৩শে জানুয়ারি ১০টি ট্রাক্টরে চেপে ২৫ জন কৃষক এসে উঠেছেন এখানে, জাসকরনও আছেন তাঁদের দলে। “২৬শে জানুয়ারির দিনটা ঐতিহাসিক হতে চলেছে, এ দেশের অন্নদাতারা বিশাল একটা কুচকাওয়াজ বার করবেন। এটা আজ ‘গণ-আন্দোলনে’ রূপান্তরিত হয়েছে,” জানালেন তিনি।
টিকরির সংগ্রামস্থলে প্রজাতন্ত্র দিবসের জন্য মুখিয়ে আছেন বছর চল্লিশেকের দেবার্জন রায়ও, গতসপ্তাহে তিন সদস্যের একটি দলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া থেকে রেলগাড়িতে করে এসেছেন এই শিল্পী। সহশিল্পী বিজু থাপারের সঙ্গে কাগজ কেটে কেটে (কাট-আউট) স্যার ছোটু রামের মতো সর্বজনবন্দিত ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতিকৃতি বানাচ্ছেন দেবরাজন। তাঁর কথায়, “চাষিদের সমর্থন জানাতে এসেছি। নিজেদের গাঁটের কড়ি খসিয়ে এই প্রতিকৃতিগুলো বানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, শিল্পের দ্বায়িত্ব সমাজের কথা বলা।” কাট-আউটগুলির মধ্যে প্রচারক বাবা রাম সিংও রয়েছেন, শোনা যায় ১৬ই ডিসেম্বর কুন্ডলি সীমান্তে তিনি গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন।

উপরে বাঁদিকে এবং মাঝখানে: প্রজাতন্ত্র দিবসের কৃষক-কুচকাওয়াজের জন্য কাগজ কেটে স্যার ছোটু রামের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি বানাচ্ছেন দেবার্জন রায় ও বিজু থাপার। উপরে ডানদিকে: ট্রাক্টরের জন্য একটি ব্যানার তৈরি করছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত পড়ুয়া ঈশিতা, কৃষি-আইনের ফলে চাষিরা কেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, সেটাই দেখানো হয়েছে ব্যানারে। নিচে ডানদিকে: কুচকাওয়াজের জন্য বানানো পোস্টার
হলদিয়াবাসী ঈশিতাও এসেছেন কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে, স্নাতকোত্তর স্তরের এই পড়ুয়াটি আপাতত ট্রাক্টরে লাগানোর জন্য একটি ব্যানার আঁকতে ব্যস্ত। সর্বগ্রাসী আইনগুলি কীভাবে চাষি তথা জনসাধারণের জীবন ছারখার করে তুলবে, সেটাই বোঝানো রয়েছে ছবির সাহায্যে।
যে তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে তিনি ও অন্যান্য কৃষকরা আন্দোলন করছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত সেই তিনটি কৃষি আইন প্রথমে অধ্যাদেশ হিসেবে পাশ হয় ৫ জুন, ২০২০, তারপর কৃষিবিল হিসেবে লোকসভায় পেশ করা হয় ১৪ই সেপ্টেম্বর এবং সেই মাসের ২০ তারিখ দ্রুততার সঙ্গে সেটিকে আইনে পরিণত করে বর্তমান সরকার। কৃষকরা যে আইনগুলির প্রতিবাদ করছেন সেগুলি হল: কৃষিপণ্য ব্যবসা – বাণিজ্য (উৎসাহ ও সুযোগসুবিধা দান) আইন, ২০২০ ; মূল্য নিশ্চয়তা ও কৃষি পরিষেবা বিষয়ে কৃষক (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি আইন, ২০২০ ; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০ ।
কৃষকরা মনে করেন এই আইনগুলি তাঁদের জীবন জীবিকা ধ্বংস করে দেবে কারণ এই আইন কৃষক ও কৃষির ওপর বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থার শক্তি আরও বৃদ্ধি করবে। এছাড়াও, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য , কৃষি উৎপাদন বিপণন কমিটি, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা সহ কৃষকদের সহায়তাকারী মূল নীতিগুলিকে লঙ্ঘন করবে এই আইন। এরই পাশাপাশি, ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদকে উপেক্ষা করে ভারতীয় নাগরিকের আইনি লড়াইয়ের পথে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্যও সমালোচনার মুখে পড়েছে এই আইন।
“কুচকাওয়াজে ভাগ নিতে কতজন চাষি আসছেন সেটা বড়ো কথা নয়,” বললেন জসপ্রীত, ২১শে জানুয়ারি লুধিয়ানা জেলার ভৈনি সাহিব থেকে টিকরিতে এসেছেন তিনি। তাঁর গ্রাম থেকে আর কেউ আসেননি, জানা গেল জসপ্রীতের কাছে। “প্রতিটা শহর, প্রতিটা গ্রামের অবদান না থাকলে এটা সফল হবে না, এই কথাটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।”
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)