বাবার সঙ্গে নিজের শেষ কথোপকথন ঘিরে বিজয় মারোত্তরের আক্ষেপ কোনওদিন ঘুচবে না।
গরমকালের ভ্যাপসা সন্ধে, ইয়াবতমাল জেলায় তাঁদের গ্রামে গোধূলি নেমে আসছিল ধীর পায়ে। মরা আলোর কুঁড়েঘরে বাবার আর নিজের জন্য দুটি থালা সাজাচ্ছিলেন তিনি— পরিপাটি করে ভাঁজ করা দুটো রুটি, ডাল আর একবাটি ভাত। কিন্তু থালার দিকে তাকিয়েই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা ঘনশ্যাম। কাটা পেঁয়াজ কোথায়? ২৫ বছরের বিজয় বলছেন, বাবার প্রতিক্রিয়ায় বাড়াবাড়ি ছিল বটে, কিন্তু সেই সময়ে তিনি যে মানসিক অবস্থায় ছিলেন তার সঙ্গে তা নেহাতই সাযুজ্যপূর্ণ। “কিছুদিন ধরেই খুব খিটখিটে হয়ে গেছিলেন,” মহারাষ্ট্রের আকপুরি গ্রামে তাঁদের এক কামরার কুঁড়েঘরের সামনে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বলছিলেন বিজয়। “সামান্য ব্যাপারে মাথা গরম হয়ে যেত।”
বিজয় সেদিন রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে বাবার জন্য পেঁয়াজ কেটে এনেছিলেন। কিন্তু খাওয়া শেষে বাবা-ছেলের মধ্যে খুব খারাপ একটা ঝগড়া হয়ে যায়। একমুখ তিক্ততা নিয়ে সেদিন শুতে গেছিলেন বিজয়। ভেবেছিলেন, সকালে উঠে বাবার সঙ্গে মিটমাট করে নেবেন।
কিন্তু ঘনশ্যামের সকাল আর হয়নি।
সে রাতেই কীটনাশক খান ৫৯ বছর বয়সি এই চাষি। বিজয় ঘুম থেকে ওঠার আগেই সব শেষ। সময়টা ছিল এপ্রিল ২০২২।
বাবার মৃত্যুর নয় মাস পর আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময়েও বিজয়ের বারবার মনে হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে যদি ফিরে যাওয়া যেত সেই কালরাতে, মুছে দেওয়া যেত বাবার সঙ্গে তাঁর সেই তিক্ত বাদানুবাদ। মৃত্যুর আগের কয়েক বছরে যে উদ্বেগাক্রান্ত মানুষটায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন তার বদলে ঘনশ্যামকে স্নেহশীল বাবা হিসেবেই মনে রাখতে চান তিনি। বিজয়ের মা, ঘনশ্যামের স্ত্রী মারা গেছেন ঘটনার দুই বছর আগে।
বাবার দুশ্চিন্তার একটা বড়ো কারণ ছিল গ্রামে তাঁদের পারিবারিক পাঁচ একর চাষজমি, যেখানে বরাবর তুলো আর অড়হর ডাল চাষ হয়ে এসেছে। বিজয়ের কথায়, “গত ৮-১০ বছর খুব খারাপ গিয়েছে। আবহাওয়া ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বর্ষা দেরিতে আসছে, গরমকাল দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। যতবার চারা লাগাই মনে হয় জুয়া খেলছি।”
এই অনিশ্চয়তার জেরে ৩০ বছর ধরে চাষ করে আসা ঘনশ্যাম ঘোর দুশ্চিন্তায় পড়েন, মনে সংশয় হতে থাকে, যে একটামাত্র কাজটা তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে পারেন সেটা তিনি আর আদৌ করতে পারবেন কিনা। “চাষ পুরোটাই সময়ের খেলা,” বলছেন বিজয়। “কিন্তু এখন আর সেই খেলা ঠিক ঠিক মিলিয়ে দেওয়ার উপায় নেই কারণ আবহাওয়ার ধাঁচ বদলে চলেছে। প্রতিবার বীজ বুনতেন, একটা করে খরার সময় যেত, আর নিজেকে দোষ দিতেন। বীজ রোপণের পর বৃষ্টি না হলে দ্বিতীয়বার আবার লাগানো হবে কিনা তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হয়,” যোগ করেন তিনি।
“দ্বিতীয়বার রোপণ করতে গেলে উৎপাদনের মূল খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়, তবে আশা থাকে যে, ফসল তোলার সময় অন্তত কিছুটা লাভ রাখা যাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য সেটা হয় না। “একটা খারাপ মরসুমে প্রায় ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকার লোকসান হত,” বলছেন বিজয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণেও পরিবর্তন এসেছে, আর তার ফলে সেচযুক্ত এলাকায় কৃষি থেকে আয় কমেছে প্রায় ১৫-১৮ শতাংশ, জানাচ্ছে OECD ২০১৭-১৮ অর্থনৈতিক সমীক্ষা । সেচ বঞ্চিত এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে সমীক্ষা থেকে।
বিদর্ভ অঞ্চলের আর পাঁচজন ছোটো চাষির মতো ঘনশ্যামেরও চাষের জন্য দামি যন্ত্রপাতি কেনার মতো সামর্থ্য ছিল না, আর তাই ভালো বৃষ্টির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন তিনি, সে যতই অনিশ্চিত হোক না কেন। “এখন আর সাধারণ বৃষ্টি হয় না,” বলছেন বিজয়। “এখন হয় খরা নয়তো বন্যা। জলবায়ুর এই অনিশ্চয়তা আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উপরেও প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতিতে চাষ করতে গেলে মনের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এই অনিশ্চয় পরিস্থিতিই বাবাকে অমন খিটখিটে করে তুলেছিল,” বলছেন তিনি।
এভাবে ক্রমাগত ‘কী হয় কী হয়’ পরিস্থিতিতে থাকা এবং শেষে গিয়ে সেই আর্থিক লোকসানের চক্রে পড়ে এই অঞ্চলের চাষিদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিয়েছে, যা কিনা আগে থেকেই চূড়ান্ত কৃষি বিপর্যয় এবং উদ্বেগজনক হারে কৃষক আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত।
ভারতে ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছেন ১১,০০০ কৃষক, তাঁদের মধ্যে ১৩ শতাংশ মহারাষ্ট্রের বলে জানাচ্ছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস্ ব্যুরো । ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যায় এখনও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে এই রাজ্য।
কিন্তু সরকারি হিসেবে যতটা ধরা পড়ে এই সংকট আসলে তার চেয়েও গভীর। কারণ , বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা ধরলে, “প্রতিটি আত্মঘাতী ব্যক্তি পিছু আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন আরও প্রায় ২০ জন।”
ঘনশ্যামের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার জেরে পরিবারের ক্রমাগত আর্থিক ক্ষতির কারণে জমা হয়েছে ঋণের পাহাড়। “আমি জানতাম যে বাবা এক মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন জমিটা বাঁচাতে,” বলছেন বিজয়। “শোধ করার চাপও তাঁর উপর ক্রমশ বাড়ছিল, যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদের পরিমাণও বেড়ে চলেছিল।”
গত ৫ থেকে ৮ বছরে একাধিক কৃষি ঋণ মকুব যোজনা তৈরি হলেও সেগুলির নানারকম শর্ত আছে। এর কোনওটিতেই মহাজনের থেকে নেওয়া ঋণ ধরা ছিল না। টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা সর্বক্ষণ মাথায় খাঁড়া হয়ে ঝুলত তাঁদের। “বাবা কোনওদিনও আমায় জানানি কতটা দেনা রয়েছে। মৃত্যুর আগের বছর দুয়েক খুব বেশি করে মদ্যপান করা শুরু করেছিলেন,” যোগ করেন বিজয়।
ইয়াবতমালের মনোসমাজকর্মী ৩৭ বছরের প্রফুল কাপসে জানাচ্ছেন, অতিরিক্ত মদ্যপান মানসিক অবসাদের একটা লক্ষণ। “অধিকাংশ আত্মহত্যার পিছনে কোনও না কোনও অন্তর্নিহিত মানসিক সমস্যা আছে,” বলছেন তিনি। “কিন্তু সেগুলো অজ্ঞাতই থেকে যায়, কারণ চাষিরা জানেন না কোথায় গিয়ে সাহায্য চাইতে হবে।”
ঘনশ্যামের পরিবার স্বচক্ষে দেখেছে কেমনভাবে তিনি উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন, উদ্বেগ, এবং মানসিক চাপের সঙ্গে লড়তে লড়তে শেষে হার মেনেছেন। তাঁদের কোনও ধারণাই ছিল না এক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে। বাড়িতে উদ্বেগ এবং মানসিক চাপের সঙ্গে লড়াই তিনি একাই করছিলেন, এমন না। ঘনশ্যামের মৃত্যুর দুইবছর আগে ২০২০ সালের মে মাসে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে এবং আগে থেকে কোনওরকম স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা ছাড়াই আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাঁর স্ত্রী কল্পনা।
“মা চাষজমি আর বাড়ির দেখাশোনা করতেন। লোকসানের কারণে বাড়ির সবাইকে খাওয়ানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। আমাদের ক্রমশ বিগড়ে চলা আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন,” জানাচ্ছেন বিজয়। “আর কোনও কারণ তো আমি দেখতে পাই না।”
কল্পনার অনুপস্থিতিতে ঘনশ্যামের সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে। “বাবা একাকীত্বে ভুগছিলেন, মা চলে যাওয়ার পর একদম খোলসে ঢুকে গেছিলেন,” বলছেন বিজয়। “আমি কথা বলতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু উনি কিছুতেই মনের কথা বলতে চাইতেন না। আমায় এসবের থেকে নিরাপদ রাখারই চেষ্টা করতেন হয়তো।”
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডি, আতঙ্ক, এবং মানসিক অবসাদ বেশি দেখা যায় চরম আবহাওয়া এবং অনিশ্চিত জলবায়ু-পীড়িত গ্রাম্য এলাকাগুলিতে, মনে করেন কাপসে। “চাষিদের অন্য কোনওরকম আয়ের উপায় থাকে না,” বলছেন তিনি। “সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে মানসিক চাপ থেকে আসে মানসিক বিপর্যয়, যা শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় অবসাদে। একদম প্রাথমিক স্তরে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে অবসাদের চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু পরবর্তী স্তরগুলিতে, যখন আত্মঘাতী চিন্তা মাথায় ঘুরতে শুরু করে, তখন ওষুধ প্রয়োজন,” যোগ করছেন তিনি।
অথচ ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে, মানসিক রোগের ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপের নিরিখে ভারত ৭০ থেকে ৮৬ শতাংশ পিছিয়ে আছে। ২০১৭ সালে মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা আইন পাশ হওয়া এবং ২০১৮ সালের মে মাসে তা বলবৎ হওয়ার পরেও মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য জরুরি পরিষেবা এখনও প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।
ইয়াবতমাল তালুকভুক্ত ভাডগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ৪২ বছর বয়সি কৃষিজীবী সীমা বাণী মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা আইন এবং সেই আইনের অধীনে প্রাপ্য পরিষেবা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন তাঁর ৪০ বছরের স্বামী সুধাকর; তারপর থেকে তাঁদের ১৫ একর চাষজমি একাই সামলাচ্ছেন তিনি।
“অনেকদিন হল নিশ্চিন্তে ঘুমোইনি,” বলেন তিনি। “তান [মানসিক চাপ] নিয়েই বাঁচি। প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে। পোটাত গোলা ইয়েতো। পেটের মধ্যে কেমন একটা গিঁট পাকিয়ে থাকে চাষের মরসুমে।”
২০২২ সালে জুন মাসের শেষ দিকে খারিফ মরসুম শুরুর সময়ে তুলো রুয়েছিলেন সীমা। ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে বীজ, কীটনাশক, সার ইত্যাদি কিনেছিলেন, দিনরাত খেটে খেটে নিশ্চিত করেছিলেন যাতে ফসল ভালো হয়, লাভের মুখ দেখা যায়। এক লক্ষ টাকার বেশি মুনাফার লক্ষ্যমাত্রার ভীষণ কাছে চলে এসেছিলেন, যখন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মেঘভাঙা বিপুল বৃষ্টিতে তাঁর তিন মাসের কঠোর পরিশ্রম ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
“মাত্র ১০ হাজার টাকার মতো ফসল বাঁচাতে পেরেছিলাম,” বলছেন তিনি। “চাষ করে মুনাফা তো দূর, লগ্নি করা টাকাটা তুলে আনতেই হাঁসফাঁস করছি। মাসের পর মাস ধরে কঠোর পরিশ্রমে জমি চাষ করো, আর দুদিনের মধ্যে সব ধুয়েমুছে সাফ। কেমন করে এটা মেনে নেব? ঠিক এই কারণেই আমার স্বামী চলে গেলেন।” সুধাকরের মৃত্যুর পর তাঁর চাষজমি আর দুশ্চিন্তা - দুইই উত্তরাধিকারে পেয়েছেন সীমা।
“আগের মরসুমে খরার জন্য ইতিমধ্যেই অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছিল,” সুধাকরের মৃত্যুর আগের সময় প্রসঙ্গে বলেন তিনি। “তাই ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তাঁর কিনে আনা তুলোর বীজগুলো যখন পচা বেরলো, সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। ওই সময় নাগাদই মেয়ের বিয়েও দিতে হয়েছিল। আর চাপ নিতে পারেননি — খাদের কিনারা থেকে পা-টা খসেই গেল।”
সীমা দেখেছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে চুপচাপ হয়ে গেছিলেন তাঁর স্বামী। তাঁর কাছ থেকে কথাবার্তা লুকিয়ে যেতেন সেটা সীমা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই চরম পদক্ষেপ করবেন সেটা কখনও ভাবেননি। “গ্রাম স্তরে আমাদের কী কিছু সহায়তার ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়?” প্রশ্ন তাঁর।
২০১৭ মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা আইনের বলে সীমার পরিবারের প্রাপ্য ছিল ভালো মানের এবং পর্যাপ্ত সংখ্যায় কাউন্সেলিং ও থেরাপি পরিষেবা, হাফ্-ওয়ে হোম, এবং আওতার মধ্যে নিরাপদ ও সাহায্যপ্রাপ্ত বাসস্থান।
গোষ্ঠী স্তরে, ১৯৯৬ থেকে বলবৎ হওয়া জেলা মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের (District Mental Health Programme/DMHP) অধীনে প্রতিটি জেলায় একজন মনোচিকিৎসক, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন মনোরোগীর নার্স এবং একজন মনোসমাজকর্মী থাকতে হবে। উপরন্তু, তালুক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতেও একজন পুরো সময়ের মনোচিকিৎসক এবং একজন মনোসমাজকর্মী থাকতে হবে।
কিন্তু ইয়াবতমালের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে মানসিক সমস্যার পরীক্ষা করেন এমবিবিএস ডাক্তাররাই। যবতমালের DMHP কোঅর্ডিনেটর ড. বিনোদ যাধব প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে উপযুক্ত চিকিৎসাকর্মীর অভাব স্বীকার করে নিচ্ছেন। “ব্যাপার যখন ওঁদের [এমবিবিএস ডাক্তার] হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়, তখনই শুধুমাত্র জেলা হাসপাতালে রেফার করা যেতে পারে,” জানাচ্ছেন তিনি।
গ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের জেলা সদরের কাউন্সেলিং পরিষেবাগুলির সম্পর্কে সীমা যদি জানতেনও, তবুও দুইদিকে এক ঘণ্টা করে বাস যাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকতে হত সীমাকে, খরচাখরচের কথা যদি না-ও বা ধরা হয়।
“সাহায্য নিতে যদি ঘণ্টাখানেকের বাসযাত্রা করতে হয়, তবে সেটা মানুষকে সেই সাহায্য নেওয়া থেকে নিরস্তই করে, কারণ এই সমস্যার জন্য বারবার আসাযাওয়া করতে হয়,” বলছেন কাপসে। সাহায্য দরকার এটুকু স্বীকার করানোই যেখানে দুঃসাধ্য, সেখানে এই ধরনের অসুবিধা সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে।
যাধব জানাচ্ছেন, জেলা মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের কর্মরত তাঁর দল প্রতিবছর যবতমালের ১৬টি তালুকের প্রতিটিতে মূলত মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষদের চিহ্নিত করতে একটা করে সচেতনতা শিবির আয়োজন করে। তাঁর মতে, “আমাদের কাছে আসতে বলার থেকে মানুষ যেখানে থাকেন সেখানে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলাটাই শ্রেয়। আমাদের পর্যাপ্ত তহবিল নেই, গাড়িরও অভাব, তবু যতটা পারা যায় করি।”
রাজ্যের জেলা মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পেরর জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারের অনুমোদন করা তহবিলের পরিমাণ তিন বছরে মোট ১৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার এই বাজেটের মাত্র ৫.৫ শতাংশ এখনও অবধি খরচ করেছে — যা দাঁড়ায় মোটের উপর ৮.৫ কোটি টাকা।
অতিমারির দুর্দান্ত প্রকোপে একাকীত্ব, আর্থিক সমস্যা, এবং মানসিক দুর্বলতার মতো সমস্যাগুলি বৃদ্ধি পেলেও গত কয়েক বছরে শিবিরের সংখ্যা কমে এসেছে অনেকটাই। এর মধ্যে যেটা চিন্তার বিষয় তা হল, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তার প্রয়োজন মানুষের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে হু হু করে।
“এই শিবিরিগুলো থেকে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই সুবিধা পান, কারণ রোগীদের বারবার দেখাতে আসতে হয় আর শিবির বছরে একবারই হয়,” বলছেন ইয়াবতমালের বাসিন্দা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. প্রশান্ত চক্করওয়ার। “প্রত্যেকটি আত্মহত্যা আসলে সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতা। এই অবস্থায় মানুষ তো হঠাৎ পৌঁছয় না। অনেকগুলো বিরূপ অভিজ্ঞতা জমে জমে এইরকম একটা প্রক্রিয়া তৈরি হয়,” আরও বলছেন তিনি।
আর চাষিদের জীবনে বিরূপ অভিজ্ঞতার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
বাবা ঘনশ্যামের মৃত্যুর পাঁচ মাস পর বিজয় মারোত্তর দেখেন তাঁর চাষের জমিতে হাঁটুজল দাঁড়িয়ে গেছে। ২০২২ সেপ্টেম্বরের অতিবৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাঁর চাষ করা তুলোর অধিকাংশই। তাঁর জীবনের প্রথম চাষের মরসুম এটা, যখন তাঁকে সাহায্য করার জন্য মাথার উপর বাবা-মা নেই। আজ তিনি সম্পূর্ণ একা।
জলে ডোবা চাষজমিটা প্রথম দেখেন যখন, বাঁচানোর জন্য পড়িমরি করে ছোটেননি তিনি। শুধু হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন। তাঁর সাধের ধবধবে সাদা তুলো যে জঞ্জাল হয়ে গেছে সেটা মেনে নিতে কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল।
“ওই ফসলে প্রায় ১.২৫ লক্ষ [টাকা] বিনিয়োগ করেছিলাম,” বললেন বিজয়। “প্রায় পুরোটাই হারিয়েছি। কিন্তু আমায় মাথা ঠিক রাখতে হবে। ভেঙে পড়ারও উপায় নেই আমার।”
ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে পার্থ এম. এন. জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।
আপনি যদি আত্মহত্যা-প্রবণ হন , কিংবা এমন কাউকে চেনেন যিনি মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন , তাহলে জাতীয় হেল্পলাইন কিরণ - এ সত্বর ফোন করুন এই নম্বরে - ১৮০০-৫৯৯-০০১৯ ( ২৪ ঘণ্টা , টোল-ফ্রি) , অথবা আপনার এলাকার অনুরূপ কোনও হেল্পলাইনে । মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা পরিষেবা-মূলক তথ্যাদির জন্য দয়া করে এসপিআইএফের মানসিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকাটি দেখুন ।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী