প্রায় ৯০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তাঁরা এখানে এসে পৌঁছে এখন দিনমজুরির কাজ জোটানোর চেষ্টায় লেগে পড়েছেন। অনিশ্চয়তাই এই শ্রমিকদের এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার পুট্টাপার্থী ও কাদিরি থেকে তাঁরা দুটি ট্রেন বদলে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছেন। জনা কয়েক কৃষক আমাকে বলছিলেন, “গ্রামগুলিতে খরার জন্য বদলি কাজও নেই (অর্থাৎ, মনরেগা বা গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প আইনের অধীনে প্রাপ্য মজুরির কাজ) এছাড়া আমরা কয়েক সপ্তাহের কাজের টাকা এখনও পাইনি।” যেটুকু কাজ আছে তা সারা বছরে কাজের চাহিদার নিরিখে এক দশমাংশে এসে ঠেকেছে।

অতএব প্রতি সপ্তাহে গুনতাকাল প্যাসেঞ্জারে চড়ে শত শত পুরুষ এবং মহিলা কোচি চলে আসেন। “কেউই টিকিট কাটে না কোচি আসার সময়। দেশে ফেরার সময় আমাদের মধ্যে অর্ধেক লোকজন টিকিট কাটে, বাকিরা কাটে না,” আমাকে জানালেন অনন্তপুরের মুদিগুব্বা ব্লক থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিক শ্রীনিবাসুলু।

PHOTO • Rahul M.

এক রবিবারে জনৈক কর্মহীন অভিবাসী শ্রমিক

অনন্তপুরে ফেরার সময় একবার শ্রীনিবাসুলু ধরা পড়েছিলেন। “কোচি শহরে বৃষ্টি হচ্ছিল। একটা জলের বোতলে আধ লিটার মদ ভরে নিয়ে ট্রেনে বসে খাচ্ছিলাম। মাঝরাস্তায় আমার মনে পড়ল টিকিট কেনা হয়নি,” কেরালায় উপার্জিত ৮০০০ টাকার মধ্যে ৮০ টাকা নিজের কাছে রেখে তিনি বাকিটা জনৈক সহযাত্রীর কাছে গচ্ছিত রেখে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

কাটপাডিতে টিকিট পরীক্ষক (টিসি) এসে শ্রীনিবাসুলুকে ধরলেন।

“টিকিট কোথায়?” টিসি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন।

শ্রীনিবাসুলুর উত্তর, “টিকিট নেই।”

“উঠে দাঁড়াও!” টিসি তেলুগু ভাষায় বললেন, “এবার চলো দেখি মামা ! (শ্যালক)।”

“ছেড়ে দাও, মামা,” শ্রীনিবাসুলু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেন। টিকিট পরীক্ষক তাঁর কাছ থেকে ৫০টি টাকা নিয়ে তাঁকে সতর্ক করে ছেড়ে দেন। মাতাল শ্রীনিবাসুলু দুলতে দুলতে পণ করেন আর কক্ষনো এই ট্রেনে চড়বেন না।

তাঁকে ছেড়ে টিকিট পরীক্ষক একটু এগোতেই শ্রীনিবাসুলু বলে উঠলেন, “স্যার, আমার খাবার কেনার টাকাটাও রইল না।” টিসি ধমক দিয়ে তিরস্কার করে টাকা ফেরত দিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলেন।

PHOTO • Rahul M.

সকালবেলা কালুরে কাজের সন্ধানে তামিল ও তেলুগু অভিবাসী শ্রমিকেরা

অভিবাসী শ্রমিকের দল প্রতিদিন সকাল সকাল কোচির কালুর জংশনে উপস্থিত হন; ধৈর্য ধরে তাঁরা রাস্তার দুইদিকে অপেক্ষা করেন কখন (পশ্চিম এশিয়ার) উপসাগরীয় দেশগুলির দিনারে সমৃদ্ধ ঠিকাদার ও জমির মালিকেরা এসে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য তাঁদের বাছাই করে নিয়ে যাবেন। এই কর্মদিবসগুলিতে তাঁরা সকাল ৬টার মধ্যে উঠে প্রাতকৃত্য, গোসল সেরে রাস্তায় এসে লাইন করে অপেক্ষা করেন। একমাত্র হাতে কাজ না থাকলেই নদীতে স্নানের সময় পাওয়া যায়, জানালেন নাগেশ নামের জনৈক শ্রমিক।

সাতটা নাগাদ কালুর জংশনে ভিড় হয়ে যায়। “কোনও কোনও মাসে আমাদের সংখ্যা সহজেই ২০০০ ছাড়িয়ে যায়,” জানালেন একজন শ্রমিক। পথের ধারের অস্থায়ী খাবারের দোকান যার অধিকাংশই অন্ধপ্রদেশ থেকে আগত পরিবারগুলি চালায় সেখানে প্রাতরাশ সেরে দুপুরের খাবার কিনে নেন শ্রমিকেরা। এখানে মূলত পাওয়া যায় মুদ্ধা (রাগি দিয়ে তৈরি রায়ালসীমা অঞ্চলের অন্যতম প্রধান খাদ্য), আচার এবং ভাত।

PHOTO • Rahul M.

ভাগ্য সন্ধানে: অনন্তপুর থেকে আগত শ্রমিকরা লটারির টিকিট কিনছেন

PHOTO • Rahul M.

কাজের অপেক্ষায় মহিলা অভিবাসী শ্রমিকেরা

কালুর জংশনে, সব দিন সমান যায় না। শ্রমিকদের সকলের কাজ না-ও জুটতে পারে। এক অভিবাসী শ্রমিক জানান, “কাজ না পেলে আমরা মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।”

মানুষ এখানে আসেন কারণ কেরলে দৈনিক মজুরি অন্তত তিনগুণ বেশি। “অনন্তপুরে আমরা দৈনিক ২০০ টাকা পাই। এখানে ৬৫০ টাকা, এমনকি ৭৫০ টাকাও পাওয়া যায়,” জানালেন অনন্তপুরে গুজরি (বাতিল, পুরাতন জিনিসপত্র) বিক্রেতা রঙ্গাপ্পা। অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন কেমন করে জমির মালিক সামান্য ঘরের কাজ করার জন্য তাঁদের ১০০০ টাকা মজুরি দিয়েছিলেন।

কালুর জংশন এলাকায় বসবাসকারী সকল পরিযায়ী শ্রমিকেরই নিজের নিজের গল্প আছে। গল্পগুলি খানিকটা এক রকমও বটে: চিনাবাদাম চাষ, অনাবৃষ্টি, মাত্রাধিক বোরওয়েল খনন এবং লোকসান বাবদ অমিল সরকারি ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ সবার জীবনেই কমবেশি সত্য। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা এবং মনরেগা প্রকল্পের কাজ না পাওয়া অথবা পেলেও সপ্তাহের পর সপ্তাহ মজুরির অপেক্ষা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

PHOTO • Rahul M.

রবিবারে খানিক জিরিয়ে নেওয়া

এখানে সব পেশার মানুষ আছেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রংমিস্ত্রি, তাঁতকর্মী, অটোচালক, প্রাক্তন সিআরপিএফ জওয়ান, ৮২ বছরের দৃষ্টিশক্তিহীন বৃদ্ধ এবং গরমের ছুটির অবকাশে এখানে হাজির বেশ কিছু পড়ুয়ার সঙ্গে আমার মোলাকাত হল। কাদিরির ১৭ বছর বয়সী রাজশেখর সবে দশম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়ে এখানে এসেছে, মজুরি বাবদ উপার্জনের টাকায় পরিবারের কিছুটা সুরাহা হবে। বালাজী নায়েকের মতো ডিগ্রিকোর্সের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই উপার্জন কলেজে পঠনপাঠন বাবদ খরচ বহন করতে সাহায্য করবে।

PHOTO • Rahul M.

মুদিগুব্বা থেকে আগত দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতায় ভোগা ৮২ বছর বয়স্ক রামুলু (বাঁদিকে), এবং পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা কাদিরির দশম শ্রেণির ছাত্র রাজাশেখর (ডানদিকে)

বছর তেইশের বালাজী কাদিরির বিবেকানন্দ কলেজে তেলুগু সাহিত্যে স্নাতক স্তরের ছাত্র ছিলেন। কলেজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি প্রতি রবিবার কাজ করতেন। কিন্তু গ্রামে কাজ অমিল হয়ে গেলে, দ্বিতীয় বর্ষের পর তাঁকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়। “পেটে খিদের জ্বালা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বিষহ জিনিস,” তিনি বলেন। পরবর্তীকালে বিয়েথা করেছেন বালাজী, এখন কাদিরি এবং কোচির মধ্যে কাজের চক্করে যাতায়াত করেই স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

তাঁর মতো আরও অনেক ছাত্র এখানে কাজের অপেক্ষায় আছেন। “আমরা কলেজের ডিগ্রি শেষ করে এখানে এসেছি,” ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা এক ছাত্র বললেন। “আমাদের অনেকেই ছুটির সময় এখানে এসে কাজ করে।”

PHOTO • Rahul M.

এক ঠিকাদার খোঁজখবর করছেন (বাঁদিকে) এবং দিনমজুরির কাজে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (ডানদিকে)

একে একে বাড়ির মালিক, ঠিকাদার জংশনে এসে পৌঁছলে শ্রমিকেরা তাঁদের চারপাশে ভিড় জমান। “ঠিকাদাররা এক ঘন্টা ধরে খোঁজখবর করে অতি সতর্কতার সঙ্গে শ্রমিকদের খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, তাঁদের বয়স এবং ক্ষমতা বুঝে অবশেষে শ্রমিকদের বাছাই করেন,” জানালেন বীরাপ্পা নামের জনৈক শ্রমিক। বেলা ১১টা নাগাদ যখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আর কাজ পাওয়া যাবে না, তখন অবশিষ্ট শ্রমিকরা কিছুক্ষণের জন্য গল্পগাছা করেন অথবা ফুটপাথের এক কোণে একটু ঘুমিয়ে নেন। কেউ কেউ নিরালা রাস্তার কোণে বসে মদ্যপান করেন।

PHOTO • Rahul M.

শেষ পর্যন্ত কাজ না পেয়ে এই শ্রমিক বেলা দশটাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন

দুপুর ১.৩০ নাগাদ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরিচালিত স্থানীয় শিব মন্দিরের অন্নসত্রে কাজ না পাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজন বিনামূল্যে মধ্যাহ্নভোজন সারেন। “শিবালয়ম অনেকের জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে,” এক শ্রমিক বলেন। “ওখানে আমাদের কেরালা চালের ভাত দেয়, তা ভালোই। সবাইকেই খেতে দেয়। আমাদের মধ্যে যাদের কাজ জোটে না, তারা এখানেই খেয়ে নেয়।”

PHOTO • Rahul M.

ভিএইচপি পরিচালিত ‘শিবালয়ম’ নামের অন্নসত্র

কাজ শেষ হয়ে গেলে শ্রমিকরা তাঁদের ঘুমানোর জায়গায় ফিরে যান। তাঁরা কালুর জংশনের ফুটপাথে এবং স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডের প্ল্যাটফর্মে ঘুমান। অনেকে বাড়ির ছাদে কিংবা মালায়ালি পরিবারের ভাড়া দেওয়া পুরনো জীর্ণ ঘরে ঘুমান।

“বিকেল পাঁচটা থেকে আলো জ্বলে, কিন্তু পাখা চলে না। রাত ১০টায় আলো নিভে গেলে তবে পাখা চলে,” বোঝান রামকৃষ্ণ, তিনি এক মালায়ালি পরিবারের ছাদের ঘরে ঘুমান। “আমরা আসলে সুইচ ব্যবহার করতে পারি না। দিনের ভাড়া মেটালে তবেই মালিক পাখা চালায়। কেউ যদি ভাড়া দিতে না পারে, তাহলে পাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়, যদিও তা এখানে রাত কাটাতে আসা ৪০ জনের সকলের জন্য!”

PHOTO • Rahul M.

রোজকার ভাড়ার হিসেব লেখা ফর্দ (বাঁদিকে) এবং কাজের শেষে ঘরের কাছাকাছি (ডানদিকে)

যাঁরা রাস্তায় থাকেন তাঁদের সমস্যা আবার অন্যরকম: মশা। ৬২ বছর বয়সী ভেঙ্কটাম্মা বলেন, “অবশ্য মশা যখন কামড়ায় তখন শরীর যে খারাপ হয় এমন না।” অনেকেই মশা এবং কোচির প্যাচপ্যাচে আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে আকণ্ঠ মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

PHOTO • Rahul M.

কালুর জংশনের ফুটপাথে নিদ্রারত মানুষ

আঞ্জনেয়ুলু, যিনি দৈনিক ৮০০ টাকার কম মজুরিতে কাজ করেন না, মদের নেশায় চুর। সারাক্ষণই মাতাল অবস্থায় থাকেন তিনি। “চন্দ্রবাবুকে (নাইডু) আমার জন্য একটা শৌচালয় তৈরি করে দিতে বলুন, আমি মদের নেশা কমিয়ে দেব। আমাদের বাড়িতে শৌচালয় নেই। প্রয়োজন সারতে নালার কাছে গেলে লোকে আমাদের দেখে চেঁচামেচি করে।”

কালুর জংশনের সকল শ্রমিকেরই কাজের নিজস্ব একটি নির্ঘণ্ট রয়েছে। অধিকাংশই প্রায় তিন সপ্তাহ এখানে থাকেন এবং তারপর এক সপ্তাহের জন্য গ্রামে ফেরেন। কেউ কেউ পুরোনো ঋণ পরিশোধ করার জন্য দীর্ঘদিন থাকেন কালুরে। মুদিগুব্বার ৪০ বছর বয়সী কৃষক নারায়ণস্বামী বলেন, “আমি এক বছরের উপর বাড়ি যাইনি। আমি প্রতি সপ্তাহে গ্রামে প্রায় ২০০০ টাকা পাঠাই।”

PHOTO • Rahul M.

৬২ বছরের ভেঙ্কটাম্মা ট্রেনে কাদিরি ফিরছেন

শ্রীনিবাসুলু বলেন, “এখানে প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও নেশা আছে। কারও তাসের নেশা, কারও বা মদের, কেউ কেউ আবার লটারির নেশায় মত্ত।”

কালুর জংশনে সড়কের দুইপাশে সার দিয়ে জমা হওয়া শ্রমিকদের একটা বিষয়ে খুব মিল - কাজের অনিশ্চয়তা।

বাংলা অনুবাদ : স্মিতা খাটোর

Rahul M.

Rahul M. is an independent journalist based in Andhra Pradesh, and a 2017 PARI Fellow.

Other stories by Rahul M.
Translator : Smita Khator
smita.khator@gmail.com

Smita Khator, originally from Murshidabad district of West Bengal, is now based in Kolkata, and is Translations Editor at the People’s Archive of Rural India, as well as a Bengali translator.

Other stories by Smita Khator