মাত্র কয়দিনের জন্যই বাড়ি এসেছেন বসন্ত বিন্দ। এই দিনমজুর গত কয় মাস পাটনার আশপাশের নানা খেতে মজুরি করেছেন। জাহানাবাদ জেলায় তাঁর গ্রাম সালেমানপুর থেকে পাটনা কয়েক ঘণ্টার পথ।
১৫ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে সংক্রান্তি পার্বণের পরের দিন আবার রোজের কাজে ফেরার পালা তাঁর। পাশের গ্রাম চানধারিয়ায় গেছিলেন আরও মজুরদের তুলতে যাতে সবাই একসঙ্গে বিহারের রাজধানী শহরে যেতে পারেন, শ্রমিকদের একটা গোটা দল থাকলে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন, এমন সময় একটা গাড়ি করে একদল পুলিশ আর আবগারি দপ্তরের আধিকারিক এসে পৌঁছন সেখানে। ২০১৬ সালের বিহার মদ নিষিদ্ধকরণএবং আবগারি (সংশোধনী) আইনের অধীনে মদবিরোধী বাহিনির সদস্য তাঁরা। এঁদের কাজ হল, ‘বিহার রাজ্যের আওতাভুক্ত এলাকায় মদ ও মাদকের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণের প্রয়োগ, রূপায়ণ এবং প্রসারণ করা…’
পুলিশ দেখে লোকে পালাতে শুরু করে। বসন্তও দৌড় দেন, কিন্তু, “আমার পায়ে একটা স্টিলের রড বসানো আছে তাই জোরে দৌড়তে পারি না।” কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাত ছেড়ে দেয় ভাগ্য, “কেউ একটা আমার শার্টের কলার ধরে টেনে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়,” মনে করছেন ২৭ বছরের বসন্ত।
তিনি ওই দলটিকে বলেছিলেন যে তাঁর নিজের এবং তাঁর বাড়িতেও তল্লাশি করতে পারে। কিন্তু তা করা হয়নি। খানিক সান্ত্বনা পেলেন এতে যে, “পুলিশ বলে যে আবগারি দপ্তরে নিয়ে গিয়ে আমায় ছেড়ে দেবে।”
কিন্তু মদবিরোধী বাহিনির সঙ্গে থানায় পৌঁছে বসন্ত আবিষ্কার করলেন যে ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে ৫০০ মিলি মদ পাওয়া গেছে বলে রিপোর্টে নথিভুক্ত হয়ে আছে। নিষিদ্ধকরণ আইনের অধীনে মদ রাখার জন্য অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে শাস্তি বাবদ পাঁচ বছরের হাজতবাস এবং প্রথমবার দোষীদের জন্য কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে।
“আমি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ওদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করেছিলাম। বলেছিলাম তদন্ত করে দেখতে।” তাঁর সব অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে এফআইআর দায়ের করে দেওয়া হয়। জেলা আদালতে যখন তাঁকে তোলা হয়, বসন্ত জানাচ্ছেন, “আমি জজ সাহেবকে বললাম আমার গোটা পরিবারে কেউ মদ বেচে না। আমায় ছেড়ে দিন।” তিনি জানাচ্ছেন, আদালত এরপর তদন্তকারী অফিসারকে ডেকে পাঠায়, কিন্তু বলা হয় যে তিনি অন্য একটা অভিযানে ব্যস্ত আছেন, আর বসন্তকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাকো জেলে। চার দিন হাজতে কাটানোর পর ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে বাড়ির লোকে এসে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যান তাঁকে— মা জমি বাঁধা রেখেছিলেন, (মামাতো) ভাই বন্ধক রাখেন মোটরসাইকেল।
*****
জাহানাবাদ জেলায় ছয়খানা থানা আছে, আর তার মধ্যে দেখা যাবে শুধু তিনটি— হুলাসগঞ্জ, পালি আর বরাবর টুরিজম থানায় নথিভুক্ত ৫০১টি এফআইআর-এর মধ্যে ২০৭টিতে অভিযুক্ত মুসহর জনগোষ্ঠীর মানুষ। রাজ্যের সবচেয়ে দরিদ্র আর প্রান্তিকতম জনগোষ্ঠীগুলি এটি। বাকি এফআইআরগুলির মধ্যে বেশিরভাগ অভিযুক্ত বিন্দ এবং যাদব, দুটিই রাজ্যে ওবিসি তালিকাভুক্ত।
“যাঁরা গ্রেপ্তার হন বেশিরভাগই দলিত বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষ, বিশেষ করে মুসহররা,” জানাচ্ছেন প্রবীণ কুমার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলিকে আইনি সহায়তা প্রদানকারী এনজিও ল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। “পুলিশ কোনও প্রমাণ ছাড়াই বস্তিতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে মেয়ে, পুরুষ, বাচ্চা সবাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেয়। ওঁরা উকিলের খরচা করতে পারেন না, তাই মাসের পর মাস জেলে থাকতে হয়,” বলছেন তিনি।
বসন্তের গ্রাম সালেমানপুরে মোট ১৫০টি পরিবার (২০১১ আদমসুমারি) আছে যার মধ্যে খুব অল্পেরই নিজস্ব জমি আছে, বেশিরভাগই দিনমজুরির উপর নির্ভরশীল। ১২৪২ জনের গ্রামের অধিকাংশই বিন্দ, মুসহর, পাসি এবং মুসলমান।
“এই দেখুন আমার বাড়ি। আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন দেখি। দেখে মনে হয় আমি মদ বিক্রি করি? আমার গোটা পরিবারে কেউ ওটা করে না,” কপালে লাগা অভিযোগের রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন বসন্ত। বসন্তের স্ত্রী কবিতা দেবীকে যখন বলা হয় যে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে আধ লিটার মদ নিয়ে ঘোরার অভিযোগ উঠেছে, সাধারণত চুপচাপ থাকা মানুষটি বলেই ফেলেছিলেন, “ও বিক্রি করতে যাবে কেন? ও তো নিজেই খায় না।”
ইটের দেওয়াল আর খড়ের চালের বাড়িটা ৩০ ফুট চওড়া একটা খালের ধারে। খালের উপর আড়াআড়িভাবে রাখা দুটো বিজলি পোল সেতুর কাজ করে। বর্ষার সময় খালের জল ফুলেফেঁপে ওঠে, তখন ওই পোল ধরে পার হওয়াটা প্রায় মরণপণ। তাঁদের আট বছরের ছেলে সরকারি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে; বড়ো মেয়ের বয়স পাঁচ, সে যায় অঙ্গনওয়াড়িতে। ছোটোটির সবে দুইবছর হল।
“আমি জানি না এই মদের নিষেধাজ্ঞা আমাদের কোন ভালোটা করছে,” বলছেন ২৫ বছরের কবিতা। “আমরা তো বিপদেই পড়ছি [নিষেধাজ্ঞার কারণে]।”
ফৌজদারি আইনে অভিযুক্ত বসন্তের সামনে এখন দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং ব্যয়সাধ্য আইনি লড়াই। “বড়োলোকের বাড়িতে মদ ডেলিভারি হয়ে যায়। ওদেরকে কেউ ঘাঁটায় না,” তিক্ততা ঝরে পড়ে তাঁর গলায়।
জামিন আর উকিলের ফিজ দিতে এরমধ্যেই ৫,০০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে বসন্তের, আরও হবে। কাজ করতে না পারায় মজুরিরও লোকসান হয়েছে তাঁর: “হাম কামায়েঁ কি কোর্ট কে চক্কর লগায়েঁ [কাজে যাব না কোর্টে চক্কর কাটব]?”
*****
“আমার নাম লিখবেন না। আপনারা লিখে দেবেন তারপর পুলিশ আমার কিছু করে দেবে… আমায় ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে হয় এখানে,” বলতে বলতে ত্রস্ত দেখায় সীতা দেবীকে [নাম পরিবর্তিত]।
তাঁর পরিবার থাকে মুসাহরিতে, জাহানাবাদ রেল স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরের এক বস্তি। তাঁরা মুসাহর গোষ্ঠীর মানুষ, রাজ্যে মহাদলিত হিসেবে নথিভুক্ত— অর্থাৎ দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীগুলির একটি।
এক বছর হল তাঁর স্বামী রামভুয়াল মাঞ্ঝিকে (নাম পরিবর্তিত) নিষিদ্ধকরণ আইনের অধীনে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সীতা দেবীর ভয় আজও যায় না।
দু’বছর আগে নিষিদ্ধকরণ আইনের অধীনে মদ রাখার দায়ে অভিযুক্ত হন রামভুয়াল মাঞ্ঝি। সীতা দেবী বলছেন, “আমাদের বাড়িতে কোনও মদ ছিল না। কিন্তু পুলিশ ওকে টেনে নিয়ে গেল। আমার ওসব বানাই না, বিক্রিও করি না। আমার স্বামী তো মদই খায় না।”
এফআইআর কিন্তু বলছে, “২৪শে নভেম্বর ২০২১ তারিখে সকাল ৮টায় পুলিশ ২৬ লিটার মহুয়া আর গুড় দিয়ে বানানো চুলাই নামের দেশি মদ বাজেয়াপ্ত করেছে।” পুলিশের আরও দাবি যে রামভুয়াল ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান এবং নিজের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন ২৪শে ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে, তাঁর বাড়ি তল্লাশির এক মাস পর।
স্বামী জেলে চলে যাওয়ার পর এক বছর অনেক কষ্টে কেটেছে সীতা দেবীর। ১৮ বছরের এক মেয়ে আর ১০ ও ৮ বছরের দুই ছেলের খেয়াল রাখতে হয়েছে একা হাতেই। জেলে রামভুয়ালের সঙ্গে যখন দেখা করতে যেতেন, দুজনেই কেঁদে ফেলতেন। “ও জিজ্ঞেস করত আমরা কেমনভাবে সামলাচ্ছি, কী খাচ্ছি। ছেলেমেয়েকে নিয়ে চিন্তা করত। আমি সমস্যার কথা বললে কেঁদে ফেলত। আমিও কাঁদতাম,” চোখের জল লুকিয়ে বলেন সীতা।
নিজের ও ছেলেমেয়ের মুখে ভাত জোটাতে খেতমজুরি করতে শুরু করেন সীতা দেবী, প্রতিবেশীদের থেকে টাকাও ধার করেন। “আমার বাবা বাটাইয়া চাষি [ভাগচাষি]। ওঁরা আমাদের চাল-ডাল দিতেন; আরও কিছু আত্মীয়ও দানাশস্য পাঠাতেন,” বলে একটু চুপ করে থেকে আবার বলেন, “এক লক্ষ টাকার বেশি দেনা হয়ে গেছে আমার।”
ভুয়ো গ্রেপ্তারি প্রমাণ করা খুব শক্ত, বিশেষ করে যখন পাঁচ সাক্ষীর একজন হল খবরি, একজন মদ ইনস্পেক্টর, আর একজন ইন্সপেক্টর এবং অভিযানে অংশ নেওয়া দুই বাহিনি সদস্য। কিন্তু ভাগ্যক্রমে রামভুয়ালের মামলা যখন শুনানি হয়। দুইজন সাক্ষী তাঁর বাড়িতে মদ পাওয়া গেছে এই বয়ান অস্বীকার করেন, এবং আদালত তাঁদের বয়ানে গুরুতর অসঙ্গতি পায়।
১৬ নভেম্বর ২০২২ তারিখে জাহানাবাদ উচ্চ জেলা এবং দায়রা আদালত রামভুয়াল মাঞ্ঝিকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।
“সুখল ঠাট্ঠর নিকলে থে জেল সে [শুকিয়ে কাঠ হয়ে জেল থেকে বেরিয়েছিল]”, বলছেন সীতা দেবী।
ছাড়া পাওয়ার দশ দিনের মধ্যে জাহানাবাদ ছেড়ে কাজের খোঁজে দেশান্তরি হন রামভুয়াল। “আমি চেয়েছিলাম অন্তত দু-তিন মাস ঠিক করে খাওয়াদাওয়া করুক। কিন্তু ওর ভয় ছিল পুলিশ ওকে আবার ধরে নিয়ে যাবে। তাই চেন্নাই চলে গেল,” বলছেন তাঁর ৩৬ বছর বয়সি স্ত্রী।
কিন্তু তাঁর গল্প এখানেই শেষ নয়।
একটা মামলায় ছাড়া পেয়ে গেলেও রামভুয়ালের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে আরও দুটি মামলা দায়ের হয় উক্ত আইনের নানান ধারায়। নিষিদ্ধকরণ ও আবগারি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নিষিদ্ধকরণ আইনে ৭.২ লক্ষেরও বেশি গ্রেপ্তারি হয়েছে। এর মধ্যে ১.৫ লক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। দোষীদের মধ্যে ২৪৫ জন নাবালক।
সীতার মনে সন্দেহ আছে স্বামী এবারে আর আদৌ ছাড়া পাবেন কিনা। মদের উপর নিষেধাজ্ঞা কোনও ভালো কাজে লেগেছে কিনা প্রশ্ন করলে সীতা বলছেন, “কোনচি ক্যা বুঝায়েগা হাম কো। হাম তো লাংটা হো গায়ে [আমাকে আর কী বোঝাবেন? আমরা তো ল্যাংটা হয়ে গেলাম]। মেয়ে বড়ো হচ্ছে, এবার বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সত্যিই জানি না কেমন করে। রাস্তায় ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।”
২০২১ সালে রামভুয়ালের ভাই অজানা রোগে মারা যান, আর তার কিছুদিন পরেই, ২০২২ সালের নভেম্বরে মারা যান ভাইয়ের স্ত্রীও। তাঁদের সন্তানদের দেখাশোনা এখন সীতাই করেন, নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে।
“ভগবান আমাদের আকাশ ভরা দুঃখ দিয়েছেন। তাই ভোগ করি।”
বিহারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে লড়াই করা এক ট্রেড ইউনিয়নিস্ট-এর স্মৃতিতে একটি বৃত্তির সহায়তায় এই নিবন্ধটি রচিত হয়েছে।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী