২০১৭ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, বিদর্ভের কার্পাসপ্রধান কৃষিক্ষেত্র সম্বলিত জেলাগুলিতে, বিশেষত ইয়াবতমালে হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে মাথা ঘোরা, স্নায়বিক দুর্বলতা, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, পেটে ব্যাথা ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসার ঘটনায় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। সকলেই কার্পাস চাষি, প্রত্যেকেই নিজেদের খেতের ফসলে কীটনাশক ছড়ানোর সময় এই কীটনাশকের সংস্পর্শ জনিত বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন মারা গেছেন, হাজারেরও বেশি অসুস্থ হয়েছেন, কেউ কেউ কয়েকমাস ধরে ভুগেছেন। এই দুর্ঘটনায় সোয়াবিন এবং কার্পাস ফসলে কীটনাশকের ক্রমাগত এবং অপরিমিত ব্যবহার স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এই ঘটনা বিদর্ভের কৃষি অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে।

তিন ভাগে বিভক্ত সিরিজের এই প্রথম প্রতিবেদনে, পারি সেই সময়কালে এই অঞ্চলে ঠিক কী ঘটেছে এবং মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃক গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম ঠিক কী খুঁজে পেয়েছে তা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছে।

অন্য আরেকটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনে, কেন এই অঞ্চলে কীটনাশকের এত বেশি ব্যবহার, সেই বৃহত্তর প্রেক্ষিতটি আমরা বোঝার চেষ্টা করব। এবং কেন বিটি-তুলো – যা এমন একটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রজাতি বা জীনপ্রযুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট ‘উন্নততর’ প্রজাতি যেটির ক্ষেত্রে দাবি করা হয়েছিল যে তার গোলাপি বোলওয়ার্ম কীটের বিরুদ্ধে জন্মগত প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে, সেই ফসল কেন এই পুরানো একটি কীটের আক্রমণে বিনষ্ট হয়ে গেল। প্রকৃত পক্ষে দেখা যাচ্ছে, গোলাপি বোলওয়ার্ম কীট যেন স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। যে ভয়টা ছিল, সেটাই বাস্তব হয়েছে, এই কীটের আক্রমণে মানুষ ব্যাপক ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছেন।

* * * * *

নামদেব সোয়াম অসংলগ্ন অবস্থায় রয়েছেন, মন্থর গতিতে হাঁটাচলা করছেন, কথার উত্তর দিচ্ছেন দ্বিধাপূর্ণভাবে, যেন বা তিনি অনেক দূরে কোথাও আছেন। তাঁর স্ত্রী ভনিতা খানিকটা তফাতে থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। “এখনও ঘোরের মধ্যেই আছে,” মৃদু স্বরে জনৈক আত্মীয় বলেন।

মুণ্ডিত মস্তক, কপালে সিঁদুরের বড় ছাপ নিয়ে পারিবারিক ঘিঞ্জি বাসায় উপবিষ্ট নামদেবের রক্তাক্ত চোখগুলি ভীত সন্ত্রস্ত। তাঁর বয়স্ক মাতা পিতা, পিতার দুটি পা কাটা পড়েছে বহুবছর আগে, বসে আছেন ২৫ বছর বয়সী নামদেবের পেছনে, নিঃশ্বাস নিতেও অনেক কষ্ট করতে হয় তাঁদের। বাড়িতে আগত অতিথিরা, অধিকাংশই সম্পর্কে আত্মীয়, একটু আগেই মধ্যাহ্নভোজন সেরেছেন – সকলেই নীরব হয়ে আছেন।

খড়ে ছাওয়া চালের নিচে, তাঁদের বাড়ির বারান্দায় নামদেবের ঠিক পাশেই, একটি প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর জনৈক তরুণ ব্যক্তির নতুন বাঁধাই করা ছবি রাখা আছে, ছবিতে দেওয়া আছে গাঁদা এবং গোলাপ ফুলের মালা। আশপাশে ফুলের পাপড়ি ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। ছবির ফ্রেমের কাছেই ধূপকাঠি জ্বেলে রাখা হয়েছে।

Namdev Soyam, with his parents, Bhaurao and Babybai, mourning the death of his younger brother, Pravin, at their home in village Tembhi of Yavatmal in September 2017
PHOTO • Jaideep Hardikar

টেম্ভী শহরে নিজেদের বাড়িতে, নামদেব সোয়াম ও তাঁর মাতা পিতা, ভাউরাও এবং বেবিবাঈ তরুণ সন্তান প্রবীণের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন

টেম্ভী গ্রামের প্রধান আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত এই কৃষিজীবী পরিবারে যে ভয়ঙ্কর এক সংকট উপস্থিত হয়েছে, তা ওই ফটোটির থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এই গ্রামটি, মহারাষ্ট্রের ইয়াবতমাল জেলার কেলাপুর তহসিলের কার্পাস ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র পান্ধরকাওড়া থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।

২৭শে সেপ্টেম্বর গভীর রাতে, মাত্র ২৩ বছর বয়সী প্রবীণ সোয়ামের মৃত্যুর পরে এখনও ৪৮ ঘন্টাও অতিক্রান্ত হয়নি। ২০১৭ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর দশেরা উৎসবের ঠিক আগের দিন আমরা তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হই।

প্রবীণ ছিলেন নামদেবের ছোট ভাই - এবং তাঁর বন্ধুও বটে। আজ প্রবীণেরর জায়গায় তিনি (নামদেব) থাকতেই পারতেন, শোকসন্তপ্ত জমায়েত থেকে কেউ একজন বলে উঠল। নামদেব অসুস্থ হওয়ার ফলে, তাঁর বাবা প্রবীণকে মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে তাঁদের চাষের জমির ফসলে কীটনাশক ছেটাতে পাঠিয়েছিলেন। “দিনটা ছিল সোমবার, ২৫শে সেপ্টেম্বর,” তাঁর বাবা ভাউরাও আমাদের বলছিলেন। ছেলের মালা দেওয়া প্রতিকৃতির দিকে চেয়ে তিনি জানান, প্রবীণ ছিলেন নামদেবের তুলনায় স্বাস্থ্যবান।

One of the relatives of the Soyams shows the different chemicals – pesticides, growth promoters, etc – that the Soyam brothers used for spraying on their cotton plants
PHOTO • Jaideep Hardikar

রাসায়নিক সংমিশ্রণ: সোয়ামের জমিতে কীটনাশক ও বৃদ্ধি-বর্ধক ওষুধ দুটোই ব্যবহৃত হয়েছে

আমরা জিজ্ঞাসা করি, “তিনি কী স্প্রে করেছিলেন?” নামদেব উঠে দাঁড়ালেন, তারপর তাঁর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং বিভিন্ন কীটনাশকের ব্যাগ ও কৌটো হাতে নিয়ে পুনরায় ফিরে এলেন: আসাতাফ, রুবি, পোলো, প্রফেক্স সুপার এবং মোনোক্রোটোফস। এগুলোকে তিনি তাঁদের বারান্দায় মাটির মেঝেতে নামিয়ে রাখলেন, ঠিক পাশেই প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর প্রবীণের এ-ফোর মাপের ছবির ফ্রেম রাখা হয়েছে।

“এগুলো কিসের জন্য?” আমরা আবার জিজ্ঞেস করলাম। নামদেব নীরবতা বজায় রেখে আমাদের দিকে তাকালেন। “কে এইসব তোমাকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে?” নামদেব এবারেও নীরবতা ভাঙেন না। তাঁর পিতা বলেন যে পান্ধরকাওড়ার জনৈক বিক্রিতা, যিনি বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ বিক্রি করেন, তিনি তাঁদের এইসব দ্রব্য জমিতে ছড়িয়ে দিতে জন্য বলেছেন। এই পরিবারটির হাতে যে ১৫ একর জমির মালিকানা আছে, তা সম্পূর্ণরূপে বৃষ্টি নির্ভর, এই জমিতে তাঁরা প্রধানত তুলো উৎপাদন করেন এবং এছাড়া কিছু পরিমাণে সোয়াবিন, ডাল ও জোয়ারও ফলান।

কীটনাশকের এই ককটেল বা সংমিশ্রণ, একটি জল ভর্তি বড় নীল প্লাস্টিকের ড্রামে মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয়, এই মিশ্রণটিই প্রবীণ সেই উষ্ণ আর্দ্র দিনটিতে তাঁদের খেতের ফসলে ছিটিয়েছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। কীটনাশক খেয়ে তিনি মারা যান নি, কৃষকদের কথায় ফসলে যে অভূতপূর্ব কীটপতঙ্গের আক্রমণ ঘটে, তার থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁদের পরিবারের জমির ফসলে কীটনাশক স্প্রে করার সময় তা দুর্ঘটনাবশত নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করায় তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রবীণের অকস্মাৎ মৃত্যুতে তাঁর পরিবার যখন শোকাচ্ছন্ন, ঠিক সেইসময় বিদর্ভ জুড়ে কীটনাশক দুর্যোগে হাহাকার শুরু হয়।

* * * * *

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে পশ্চিম বিদর্ভের ইয়াবতমাল ও অন্যান্য স্থানে প্রায় ৫০ জন কৃষক মারা যান এবং এক হাজারেরও বেশি কৃষিজীবী মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। (সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত হতাহতের এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মৃত এবং অসুস্থ মানুষের সংখ্যা নির্ধারিত হয়।) বেশ কিছু মানুষ তাঁদের দৃষ্টিশক্তি হারালেও, কীটনাশকের ওই মারাত্মক মিশ্রণের সংস্পর্শে না আসায়, তথা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে না যাওয়ায় সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যান।

রাজ্যের স্বাস্থ্য ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে যথারীতি বিলম্ব করা হয়; যদিও দুর্ঘটনার ব্যাপকতা এবং গুরুত্ব শেষ পর্যন্ত সরকারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য নভেম্বরে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করতে বাধ্য করে (এসআইটি রিপোর্ট এবং এর সুপারিশগুলি একটি পৃথক কাহিনি হিসাবে পারিতে প্রকাশিত হবে)।

সমগ্র ইয়াবতমাল জেলা জুড়ে ওই তিন মাস ধরে কাতারে কাতারে কৃষকেরা, দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পাওয়া, স্নায়বিক দুর্বলতা, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় হাসপাতালেই হাজির হন। (দেখুন: ধোঁয়া এবং ত্রাসে আচ্ছন্ন ইয়াবতমাল)।

ইয়াবতমালের বসন্তরাও নাইক সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের (জিএমসিএইচ) ডীন ডাঃ অশোক রাঠোড় তখন এই প্রতিবেদককে জানান, “এটা খুব অস্বাভাবিক একটি ঘটনা, আমি আজ অবধি এইরকম কোন ঘটনা ঘটতে দেখি নি।” তাঁর ভাষায়, “আমরা খেয়াল করলাম, হঠাৎ এইরকম সমস্যা নিয়ে আসা রুগীদের সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটেছে। তাঁরা সকলেই খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন; বমি, মাথা ঘোরা, স্নায়বিক দুর্বলতা, হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আসছিলেন তাঁরা।” জেলা সদর হাসপাতালের ১২, ১৮ এবং ১৯ – এই তিনটি ওয়ার্ড বিষাক্ত স্প্রের সংস্পর্শে আসা কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের ভিড়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

Ward number 18 of the Yavatmal Government Medical College and Hospital was flooded with patients mostly farmers who had accidentally inhaled toxic pesticides while spraying on their fields between July and November. This photo was taken in September 2017
PHOTO • Jaideep Hardikar
Raghunath Shankar Kannake, 44, a marginal farmer, was among the tens of farmers who were admitted to Ward 19, of the Yavatmal Government Medical College and Hospital, during the September-November 2017 incidence following accidental inhalation of pesticide while spraying it on their farms
PHOTO • Jaideep Hardikar

ইয়াবতমালের সরকারি হাসপাতাল কৃষকদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, ফসলে কীটনাশক ছড়ানোর সময়ে এর বিষাক্ত ধোঁয়া দুর্ঘটনাবশত তাঁদের নাকে প্রবেশ করে

ডাঃ রাঠোড় জানান, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ৪১ জন রুগী জিএমসিএইচ-এ এসেছিলেন। অগস্ট মাসে এই সংখ্যা বেড়ে ১১১ তে পৌঁছায়, সেপ্টেম্বর মাসে দেখা গেল ৩০০ জন রোগী জিএমসিএইচ-এ উপস্থিত হয়েছেন - তাঁদের প্রত্যেকেরই একই রকম সমস্যা রয়েছে। আগামী অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এই সঙ্কট চূড়ান্ত রূপ নিল যখন একা ইয়াবতমাল জেলারই বিভিন্ন হাসপাতালগুলিতে এক হাজারেরও বেশি কৃষিজীবী মানুষ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন। একই অভিযোগ আকোলা, অমরাবতী, নাগপুর, ওয়ার্ধা এবং ওয়াশিম জেলা থেকেও আসছিল।

রাজ্যের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। একই অবস্থা হল স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাদের। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই সংকটের দ্রুত মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছেন এই অভিযোগে ডাঃ রাঠোড়কে শাস্তিস্বরূপ ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে, এবং নাগপুরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান, ডাঃ মনীশ শ্রীগিরিওয়ারকে জিএমসিএইচ-এ নতুন অস্থায়ী ডীন করে পাঠানো হয়।

নভেম্বরের শেষের দিকে, শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এবং আতঙ্কগ্রস্ত কৃষকেরা কীটনাশকের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়ায় অসুখের ঘটনাগুলি ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করে। অবশ্য, ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে – কৃষি নির্ভর মানুষ এবং কার্পাস তুলোর ফসল -দুটোই পোকার অভূতপূর্ব আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

* * * * *

বার্ষিক চুক্তিতে খেতমজুর হিসেবে জমিতে কাজ করার সময়ে, টানা সাতদিন ধরে কীটনাশক ছড়ানোরর সপ্তম দিনে, অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন দুপুর নাগাদ, ২১ বছর বয়সী নিকেশ কথাণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

“আমার অসম্ভব মাথাভার লাগছিল, আমি কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না”, অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াবতমাল শহরের জিএমসিএইচ-এর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)-এর একটি বিছানায় চিকিৎসাধীন নিকেশ কথাণে আমাদের বলেন, তাঁর পেছনে তাঁর পিতা-মাতা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর ভাই লক্ষ্মণ বলেন, “সেইদিন সন্ধ্যায় তাকে আমরা তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাই।” এইজন্যই সে যাত্রা তিনি প্রাণে বেঁচে যান। হাসপাতালে আসতে আর একটু বিলম্ব হলেই তা মারাত্মক প্রমাণিত হত। নিকেশ পণ করেছেন, এই জীবনে আর কখনও কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করবেন না; নিকেশ ভুগছিলেন পেশির খিঁচুনিতে। বিপদ কেটে গেলেও আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন এমন নয়জন রোগীকে তাঁর নিজের চারপাশে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। যখন আমরা তাঁর সাথে কথা বলেছিলাম, সেইসময়ে তিনি পুরো এক সপ্তাহের জন্য হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন

Nikesh Kathane, a 21-year-old farm labourer, recuperating in the ICU of the Yavatmal Government Medical College and Hospital in September 2017, after falling sick in the wake of accidental inhalation of pesticide while spraying it on his owner’s field. With him are his parents Keshavrao and Tarabai and his elder brother Laxman
PHOTO • Jaideep Hardikar

২১ বছরের কৃষি শ্রমিক নিকেশ কথাণে, ইয়াবতমাল শহরের হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন; সঙ্গে রয়েছেন তাঁর উদ্বিগ্ন ভাই এবং মা-বাবা

তিনি চিনের তৈরি ব্যাটারি চালিত স্প্রে-পাম্প ব্যবহার করেছিলেন – মেশিনটির মাধ্যমে স্প্রে করা সহজ হলেও এবং কাজটি ঝটপট করে ফেলা গেলেও – যন্ত্রটি বহুগুণ বেশি বিপজ্জনক। “এই যন্ত্র খুব অল্প সময়ে অনেক বেশি কীটনাশক স্প্রে করে” নিকেশ বলেন।

কথাণে পরিবার, ইয়াবতমাল শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, রালেগাঁও তেহসিলের দাহেগাঁও গ্রামের অধিবাসী। লক্ষ্মণ কথাণে জানান, এই একই গ্রামের আরও পাঁচজন রোগী হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন; তাঁদের অবস্থা অতখানি গুরুতর না হলেও, তাঁরাও কীটনাশকের বিষক্রিয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।

হাসপাতালের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে, ওয়াদগাঁও গ্রামের দিগরস তেহসিলের ২৯ বছর বয়সী কৃষক ইন্দল রাঠোড় ভর্তি ছিলেন; তাঁর পরিবারের চার একর জমি রয়েছে। তিনি প্রায় দিন দশেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন; তাঁর ছোট ভাই অনিল আমাদের বলছিলেন ইন্দল এখনও অসংলগ্ন অবস্থাতেই আছেন।

মানুষের মধ্যে দানা বাঁধা আতঙ্ক এবং আশঙ্কা শুধুমাত্র এইসব হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলিতে নয়, সমস্ত জেলা জুড়েই গোচর হচ্ছিল।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে এই প্রতিবেদক বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন যে, তাঁরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ফসলে কীটনাশক ছেটানো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনই একজন কৃষক মনোলী গ্রামের নারায়ণ কোটরঙ্গে, অন্য এক গ্রামবাসীর কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ১০ একর জমিতে প্রোফেক্স সুপার ছেটানোর পর তাঁর মাথা ঘুরতে থাকে। তাঁর কথায়, “আমি ইতিমধ্যেই নয়বার কীটনাশক স্প্রে করে ফেলেছিলাম। এবং দশমবারে, আমি কাজটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম; পরবর্তী পুরো সপ্তাহটাই আমি কাজ করতে পারি নি, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।”

A four-acre farmer from Manoli village, Vilas Rathod, in Yavatmal’s Ghatanji tehsil inspects his cotton crop; Rathod stopped spraying after he fell sick, but did not need hospitalization
PHOTO • Jaideep Hardikar
One of the farmers, completely disoriented, had to be tied to his bed in the ICU of the Yavatmal hospital so that he did not fall down as his body jerked
PHOTO • Jaideep Hardikar

কীটনাশকের বিষাক্ত ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করায় অসুস্থ হয়ে পড়লেও (বাঁদিকে) বিলাস রাঠোড়কে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি বটে, কিন্তু অন্যান্য কৃষক ও শ্রমিকেরা তীব্র বিষক্রিয়ার চোটে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন

প্রতিটি গ্রামেই কীটনাশক ছেটানোর পর কেউ না কেউ অসুস্থ হয়েছিলেন। “হাসপাতালের আইসিইউতে নিখিল ও অন্যান্যদের চিকিৎসায় ব্যস্ত জুনিয়র আবাসিক (রেসিডেন্ট) ডাক্তার, ডাঃ পরাগ মানাপে জানান, “রোগীদের রক্ত ​​পরীক্ষা করে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় তাঁদের স্নায়ুতন্ত্র প্রভাবিত হয়েছে।” তিনি বলেন, বিষ পেটে গেলে যতটা মারাত্মক হতে পারে, এক্ষেত্রেও প্রভাব ততটাই ভয়াবহ হয়েছিল। তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝান, এক্ষেত্রে চিকিৎসা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায় কারণ, বিষের কণাগুলিকে ‘স্টমাক ওয়াশ বা পেটের ভেতরটা ধুয়ে’ শরীর থেকে বের করে দেওয়া সম্ভব হয়নি – কীটনাশকের ধোঁয়া  নিঃশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসযন্ত্রটিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।

অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কৃষকদের বয়ান থেকে দুটি স্পষ্ট প্রবণতা উঠে আসে: পাউডার বা গুঁড়ো একটি বিশেষ কীটনাশক যাঁরা ব্যবহার করেছেন তাঁদের মধ্যে দৃষ্টি শক্তির সমস্যা দেখা দিয়েছে। এবং অন্যদিকে, যাঁরা একটি নির্দিষ্ট তরল কীটনাশক ব্যবহার করেছেন, তাঁদের স্নায়ুতন্ত্র ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই কীটনাশক ওষুধগুলিতে থাকে প্রফেনোফস (এক ধরনের অর্গানোফসফেট), সাইপারমেথ্রিন (এক ধরনের কৃত্রিম পাইরেথ্রয়েড) এবং বহুবিধ ফসলে রকমারি কীটপতঙ্গ (পেস্ট-কমপ্লেক্স) রোধ করার জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক ডায়াফেন্থিউরন। কৃষকেরা বলেন, সবগুলি একসঙ্গে মিশ্রিত হলে তৈরি হয় প্রাণঘাতী এক সংমিশ্রণ যা মানুষ মারার জন্য যথেষ্ট।

* * * * *

টেম্ভী গ্রামের সোয়াম পরিবারের প্রবীণের শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল। প্রথমে তিনি বুকে ব্যথার অভিযোগ করেন, তারপর সারাক্ষণ বমি বমি ভাব এবং বমি, শেষে স্নায়বিক দুর্বলতার লক্ষণ দেখা দেয়। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাঁর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একদিন পরে পান্ধরকাওড়ার একটি ছোট হাসপাতালে নিয়ে আসার ঠিক তিন ঘণ্টা পর তিনি মারা যান। মাত্র দুই দিনের মধ্যে সব শেষ গেল।

হাসপাতালের চিকিৎসকদের ধারণা, প্রবীণ কীটনাশক স্প্রে করার সময় বিষ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহণ করেন নি এবং বিষাক্ত ধোঁয়া শরীরের সংস্পর্শে আসার কারণে বিষক্রিয়ার প্রভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই অঞ্চলে প্রায় কেউই বিষ প্রতিরোধকারী দস্তানা ও মুখোশ এবং নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা-জামা ব্যবহার না করেই এই মারাত্মক কীটনাশক ছেটানোর কাজ করেন।

ভাউরাও বলেন, “নামদেব অসুস্থ হয়ে পড়েছে দেখে আমি তাকে জমির কার্পাস ফসলে কীটনাশক স্প্রে করতে বলি।” এই বছর, তাঁদের গ্রাম তথা এই সমগ্র অঞ্চলের অন্যান্য কৃষকদের মতোই সোয়াম পরিবারও ২০১৭ সালের জুলাই মাস নাগাদ তাঁদের ফসল নানা রকম পোকামাকড়ের দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখে নানাবিধ কীটনাশকের মিশ্রণে তৈরি ওষুধ অনেক বেশি মাত্রায় ব্যবহার করতে বাধ্য হন।

কীটনাশক স্প্রে করার পরেই প্রবীণ শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করতে থাকেন, তা সত্ত্বেও তিনি ডাক্তারের কাছে যেতে অস্বীকার করেন। “আমরা ধরে নিই গরম থেকে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই সময়ে বেশ গরম পড়েছিল এবং আমাদের গ্রামে বছরের এই সময়ে সাধারণত জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়,” ভাউরাও স্মরণ করেন। প্রবীণের অবস্থায় অবনতি হলে পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় নামদেব এবং তাঁর মা বেবিবাঈ তাঁকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একজন সহায়ক প্রবীণকে দেখে বিপদ আঁচ করতে পেরে তাঁকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পান্ধরকাওড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।

বেবিবাঈ জানান, তাঁরা প্রায় সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন। তাঁদের তরুণ সন্তান প্রবীণ রাত ১০টায় মারা যান। তাঁর পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে লেখা আছে: “মৃত্যুর কারণ অর্গানোফসফেটজনিত বিষক্রিয়া।”

Jaideep Hardikar

Jaideep Hardikar is a Nagpur-based journalist and writer, and a PARI core team member.

Other stories by Jaideep Hardikar
Translator : Smita Khator
smita.khator@gmail.com

Smita Khator, originally from Murshidabad district of West Bengal, is now based in Kolkata, and is Translations Editor at the People’s Archive of Rural India, as well as a Bengali translator.

Other stories by Smita Khator