ছত্তিসগড়ের রায়পুর জেলার ধামতারি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে লোহারশি গ্রামের মেয়েদের প্রাইমারি স্কুলের চেহারা একেবারেই আলাদা। বাইরে থেকে এক ঝলক আর স্কুলের সীমানার ভেতরের পুরোনো পিপুল গাছের চেহারা দেখে আন্দাজ করাই যায় এর বয়েস ৮০-৯০ বছরের কাছাকাছি। স্কুলের ভেতর ঢুকে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা দেখা হলেই বোঝা যায় কত প্রাণবন্ত এই স্কুল।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় তিন দশক আগে, ১৯১৮ সালে এই স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। আজ ৯৬ বছর ধরে স্কুলের সমস্ত শিক্ষার্থীর নাম সযত্নে নথিভুক্ত রাখা হচ্ছে একটা রেজিস্টারে। স্কুলের শিক্ষিকা নীলিমা নেতাম জানাচ্ছেন যে তাঁরা একটা উঁই-কাটা খাতা পান কাঠের বাক্সের ভেতর যেটায় স্কুল যে বছর চালু হল সেই বছর থেকে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরদের বিষয়ে তথ্য নথিভুক্ত করা আছে। তাঁরা সেই খাতার মলাট বদল করেছেন, এবং এই ধরনের নথির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন কারণ এটি এমন একটা দলিল যা স্কুলের ইতিহাস জানতে সহায়তা করবে।

PHOTO • Purusottam Thakur

প্রায় একশ বছর পুরোনো স্কুলটির প্রবেশদ্বার

‘প্রমোশান বুক’ জাতীয় কিছু কিছু নথি আমরা এই সংগ্রহ থেকে দেখতে পেয়েছিলাম। এর কিছুটা অংশ উঁই পোকায় খেয়ে ফেলায় বেশ কিছু নাম আর তথ্য অস্পষ্ট হয়ে গেছে বটে, বাকিটা কিন্তু অক্ষতই আছে। দোয়াতের কালিতে কলম ডুবিয়ে বড়ো-বড়ো সুন্দর অক্ষরে যাবতীয় তথ্য লেখা হয়েছিল।

কিছু নাম এইরকম - বানীন বাই তেলিন, সোনা বাই কোষ্টিন, দ্রুপৎ বাই লোহারিন, রামসীর বাই কালারিন, সুগন্ধীন বাই গোণ্ডিন, নামের পাশে জাতের উল্লেখ রয়েছে স্পষ্ট করে। এর কারণ মনে হয় এই যে, হাতে লেখা রেজিস্টার ঠিক মুদ্রিত রেজিস্টারের মতো নয় - যেখানে পড়ুয়ার নাম, অভিভাবকের নাম আর জাত উল্লেখ করার জন্য অলাদা-আলাদা কলাম থাকবে - ফলে একটানা সমস্ত তথ্য লিখে নেওয়া হত একবারে।

এই দস্তাবেজ থেকে আমরা জানতে পারি সেই সময়ে কী পড়ানো হত। যেমন, সাহিত্য পাঠের মধ্যে ছিল কথপোকথন, গল্প-কাহিনি, নাটক, গদ্য, অভিব্যক্তি, শব্দার্থ, কবিতা, শ্রুতি-লিখন, হস্তাক্ষর, আর প্রতিলিপি বা মকশো করা। আর অঙ্কে থাকত গণনা, সমীকরণ, হিসেব-নিকেশ, লেখন পদ্ধতি, সরল মাপজোখ, সূত্র, নামতা, মৌখিক আর লিখিত যোগ-বিয়োগ। শিক্ষক জ্যোতিষ বিশ্বাস জানালেন, “সেই সময়ে ধারাবাহিক সার্বিক মূল্যায়নের প্রচলন ছিল।”


PHOTO • Purusottam Thakur
PHOTO • Purusottam Thakur

উঁই-কাটা রেজিস্টারের পৃষ্ঠা

এই রেজিস্টার খাতা থেকে জানা যায় যে অনেক ছাত্রী বয়সন্ধির সময় স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। ছাড়বার কারণ হিসেবে বয়সন্ধির কথা লেখাও আছে। এছাড়াও দারিদ্র এবং অভিবাসনও স্কুল ছাড়ার কারণ হিসেবে উল্লিখিত আছে এই নথিতে। সে সময় লোহারশি ছাড়াও পাশের গ্রাম আমডি আর মুজগহন থেকেও মেয়েরা এই স্কুলে পড়তে আসত।

এই পুরোনো নথিটি সে আমলের সমাজের একটা দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের সামনে এনে দেয়। ১৯১৮ সালের রেজিস্টারে দেখা যাচ্ছে প্রাথমিকভাবে এই স্কুলের নাম ছিল কন্যাদের স্কুল। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়। ১৯১৮ সালে ৬৪ জন ছাত্রী আসত এই স্কুলে। আজ এই স্কুলের মোট ছাত্রী সংখ্যা ৭৪। এদের মধ্যে একজন তপশিলি জাতির, ১২ জন তপশিলি জনজাতির এবং ২১ জন অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা তিনজন।

PHOTO • Purusottam Thakur

কর্মরত শিক্ষকদের তালিকা

এই রেজিস্টার খাতা থেকে জানা যায় যে অনেক ছাত্রী বয়সন্ধির সময় স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। ছাড়বার কারণ হিসেবে বয়সন্ধির কথা লেখাও আছে। এছাড়াও দারিদ্র এবং অভিবাসনও স্কুল ছাড়ার কারণ হিসেবে উল্লিখিত আছে এই নথিতে

শুধু অতীতের নয়, বর্তমানেও এই স্কুল নানা সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। মিডডে মিল পরিবেশনের সময় শিক্ষক ও ছাত্রীরা একসঙ্গে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন; ছাত্রীদের দেখে মনে হয় তারা শিক্ষকদের খুব কাছের এবং পরস্পরের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ছাত্রীরা হিন্দি এবং ছত্তিসগড়ী ভাষায় বেশ কিছু গান শিখেছে যা তারা সবাই মিলে একসঙ্গে গায়। ক্লাস ঘরে দেয়ালে নানা রঙের পশু পাখির ছবি সাঁটা। শিক্ষক জ্যোতিষ বিশ্বাস এসব এঁকেছেন। তিনি বললেন, “ছবিগুলো পাঠ্যবইয়ের বিষয়কে ভিত্তি করেই আঁকা। এগুলি ছাত্রীদের পড়তে, লিখতে বা বুঝতে সহায়ক হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, এইসব ছবি ছাত্রী আর শিক্ষকদের মিলিত প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে।”

PHOTO • Purusottam Thakur

গল্প-কাহিনি , নাটক, গদ্য, কবিতা আর কথোপকথনের ক্লাস হয়

সুমিত কুমার যদু বর্তমানে স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি বললেন নিজের স্কুলের আরও আরও ছাত্রীদের নবোদয় স্কুলে ভর্তি হতে দেখতে চান এবং এখানে তাদের আগামীদিনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে।

স্কুলের পুরোনো বাড়িটা সংস্কার করা প্রয়োজন। অথবা একটা নতুন বাড়ি দরকার যেটা আরও বেশি খোলামেলা হবে। তবুও এক ঝলকে স্কুলের পুরোনো ইতিহাসে চোখ রাখতে আর তার সঙ্গে এখনকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উৎসাহ চাক্ষুষ করে ভালো লাগে। বহু ছাত্রীই গরিব পরিবার থেকে পড়তে এসেছে, তাদের পায়ে জুতোও নেই। কিন্তু তাদের হাবভাব দেখেই বোঝা যায় একদিন তারা নিজেদের এই স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে।

PHOTO • Purusottam Thakur
PHOTO • Purusottam Thakur

বাঁদিকে: অবসরের সময় ছাত্রীরা। আগে স্কুলের নাম ছিল ‘কন্যা বিদ্যালয়’ বা ‘ডটারস স্কুল’। পরবর্তীকালে এই নাম বদলে রাখা হয় প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়

হিন্দি থেকে অনুবাদ করেছেন রুচি ভার্সনেয়া

ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী রুচি ভার্সনেয়া স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আইআইটি রুরকি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জামশেদপুরের এক্সএলাআরআই থেকে এমবিএ ডিগ্রির পাশাপাশি রুচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও লাভ করেন আশা ফর এডুকেশন স্নগস্থার জন্য অর্থ সংগ্রহ করার তাগিদে তিনি দৌড়ে অংশ নেন, পারি এবং কাব্যালয়-এর সঙ্গে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে যুক্ত।

বাংলা অনুবাদ : শৌভিক পান্তি

Purusottam Thakur
purusottam25@gmail.com

Purusottam Thakur is a 2015 PARI Fellow. He is a journalist and documentary filmmaker. At present, he is working with the Azim Premji Foundation and writing stories for social change.

Other stories by Purusottam Thakur
Translator : Shouvik Panti
shouvikpanti@gmail.com

Shouvik Panti is from Dhanyakuria, a small town in North 24 Pargana, West Bengal. He is now based in Kolkata. He has a master’s degree in Bangla literature and specialises in digital humanities. He loves searching for timeworn, dusty and priceless books in Kolkata’s famous College Street book stalls.

Other stories by Shouvik Panti