আজব কর্মশালা বটে, কোথাও কোনও নাম-লেখা সাইনবোর্ড নেই। "ইয়েহ্ তো এক গুমনাম দুকান হ্যায় [এটা তো একটা নামহীন দোকান]," বলেছিলেন মোহাম্মদ আজিম। ভিতরে ৮ বাই ৮ অ্যাসবেস্টসের দেওয়ালগুলো ঝুলকালি মাখা আপাদমস্তক। এক কোণে ছোট্ট একটা লোহার উনুন রাখা, মধ্যিখানে বিরাজমান নীলচে ত্রিপলে ঢাকা একঢিপি পোড়া কালো মাটি।

পশ্চিম হায়দরাবাদের দুধ বাউলির অলিগলি, প্রতিদিন সকাল ৭ বাজতে না বাজতেই সাইকেল নিয়ে রওনা দেন আজিম। কর্মশালা আর হাকিম মির ওয়াজির গোরস্থানের মাঝে একটাই দেওয়াল, বাহনখানা সেখানেই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ধুলোয় ভরা প্লাস্টিকের কৌটো, জং ধরা লোহার বাক্স, ভাঙাচোরা বালতি, যন্ত্রপাতি, ছাপ-মারার ছেনি (পাঞ্চ), সব এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝের উপর যে কাজ করার জায়গা মেলা ভার – এভাবেই শুরু হয় তাঁর দিনগুলো। গলানো ধাতু বালির ছাঁচে ঢেলে (স্যান্ড-কাস্টিং) একে একে তৈরি হয় টোকেন।

হায়দরাবাদের খানকতক পুরানো চায়ের দোকান আর খাবারদাবারের গুমটিতে আজও ব্যবহৃত হয় ২৮ বছর বয়সী আজিমের হাতে বানানো এই টোকেনগুলি। এককালে অবশ্য এরকম 'ক্যান্টিন টোকেনের' দেখা আরও অনেক জায়গাতেই মিলত – যেমন কারখানা, সামরিক কেন্দ্র, রেলওয়ে, ব্যাংক, ক্লাব, সমবায় তথা আরও হরেক রকমের প্রতিষ্ঠানে। তবে কালের নিয়মে মানুষ আস্তে আস্তে প্লাস্টিকের টোকেন বা কাগজের রসিদের দিকে ঝুঁকেছে, সেকেলে ধাতুর টোকেনের আর চাহিদা নেই তেমন। হায়দরাবাদের হাতে গোনা যে কটা রেস্টুরেন্টে আজও এ টোকেনের ব্যবহার টিকে আছে, সেখানে সারাদিনে কত আয় হল তারই হিসেব রাখতে কাজে লাগে এই চাকতিগুলি: খদ্দের কিছু খাবার চাইলে তাকে সেই খাদ্যবস্তুটির নিরিখে নির্দিষ্ট টোকেন দেওয়া হয়।

বাড়ির লোকজন, আশেপাশের দোকানের মালিক, আজিমকে সবাই আজ্জু বলে ডাকেন আদর করে। ওঁর মতো এমন ধাতব টোকেন বানাতে ওস্তাদ ১০ জন কারিগরও বোধহয় আর নেই হায়দরাবাদে, আন্দাজ আজ্জুর।

Every morning, Azeem parks his bicycle near the shop and begins his workday, moulding tokens with inscriptions or shapes of the dishes sold in eateries
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
Every morning, Azeem parks his bicycle near the shop and begins his workday, moulding tokens with inscriptions or shapes of the dishes sold in eateries
PHOTO • Sreelakshmi Prakash

সাত সকালে দোকানের কাছে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রেখে টোকেন বানানোর কাজ শুরু করেন আজিম। টোকেনগুলোয় হয় দোকানে বিক্রি হওয়া খাবারের নাম খোদাই করা থাকে, কিংবা সেটা বানানোই হয় সেই খাদ্যবস্তুটির আকারে

বাক্সের পসরা থেকে একমুঠো টোকেন বার করে সাজিয়ে রাখলেন মেঝেতে। ইংরেজিতে খোদাই করা আছে: চা, ভাত, ইডলি, পায়া, মাছ, সিবিএস (চিকেন বিরিয়ানি সিঙ্গল), সিবিজে (মাটন বিরিয়ানি সিঙ্গল), এমবিজে (মাটন বিরিয়ানি জাম্বো), প্রভৃতি। কয়েকটার তো আবার আকারগুলোই খাবারের মতন – চায়ের পট, মাছ, মুরগি, ছাগল, দোসা ইত্যাদি।

"এসব মুদ্রা বানানোর ওস্তাদ আমরা, এককালে সারা হায়দরাবাদ ঝেঁটিয়ে দোকানদারের দল কিনতে আসত এগুলো। আর আজ বিক্রিবাটার এমন দুরবস্থা যে কী বলব..." আজিমের কাকা মোহম্মদ রহিম জানালেন। বছর ষাটেকের এই মানুষটিও প্রথাগত কায়দায় টোকেন ঢালাই করেন।

ওঁর কাছে জানা গেল যে হায়দরাবাদের শেষ নিজামের রাজত্বকালে (১৯৪৮ অবধি) আজিমের ঠাকুমা-ঠাকুর্দাও বালির ছাঁচে ধাতু ঢেলে টোকেন আর গয়নাগাঁটি বানাতেন, খাস রাজপ্রাসাদে যেত সেসব বস্তু। এছাড়াও বাড়িতে সাজানোর টুকিটাকি শৌখিন জিনিস বানাতেন তাঁরা। লোকে এককালে সাইকেল কিনলে ধাতুর পাতে নিজের নাম খোদাই করিয়ে সেটা হাতুড়ি মেরে বসিয়ে দিত বাহনের গায়ে, এই কাজটাও করতেন রহিম। বহু যুগ আগে তাঁর আব্বার হাতে গড়া এমনই একটি সাইকেলের পাত বার করে এনে দেখালেন আমাদের।

আজিমের আব্বা মোহাম্মদ মুর্তুজা ছিলেন মুদ্রা বানানোর ওস্তাদ, মহল্লায় বিশাল নামডাক ছিল তাঁর। তবে কয়েক দশক আগে, আজ্জু তখনও জন্মাননি, চুল্লি ফেটে ডানহাতটা এমন জখম হয় যে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল শেষে।

তা সত্ত্বেও বাপ-মায়ের ঐতিহ্য নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে ছাড়েননি মুর্তুজা আর রহিম। ঠিক কত বছর বয়সে ঢালাইয়ের কাজ শুরু করেছিলেন সেটা মনে করতে পারলেন না আজিম; ক্লাস ফোরে পড়াকালীন একবার এক বন্ধুর সঙ্গে বিশাল মারামারি করেছিলেন, সাত তাড়াতাড়ি ইস্কুল থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন আব্বা। ছাঁচে ফেলে মুদ্রা বানানোটাই তাঁর একমাত্র সম্বল এখন, বলে উঠলেন আজ্জু, এ ছাড়া আর কিছুই জানেন না তিনি।

Moulding tokens is a family tradition: Azeem's wife Nazima (centre) would pitch in when they had a furnace at home. His father (right) was a master craftsman
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
Moulding tokens is a family tradition: Azeem's wife Nazima (centre) would pitch in when they had a furnace at home. His father (right) was a master craftsman
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
Moulding tokens is a family tradition: Azeem's wife Nazima (centre) would pitch in when they had a furnace at home. His father (right) was a master craftsman
PHOTO • Sreelakshmi Prakash

ছাঁচে ফেলে টোকেন ঢালাই এঁদের পারিবারিক পরম্পরা: বাড়িতে এককালে যখন চুল্লি বসানো ছিলো, তখন আজিমের স্ত্রী নাজিমাও (মাঝখানে) হাত লাগাতেন কাজে। ওস্তাদ কারিগর ছিলেন আজ্জুর বাবাও (ডানদিকে)

বিগত কয়েক দশক ধরে বারংবার দোকান পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে পরিবারটি – জায়গার অভাব, কিংবা ভেঙে ফেলা হয়েছে দোকানবাড়ি, কখনও বা চুল্লির ধোঁয়ার বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকেছেন পড়শিরা। চারমিনারের কাছেই একটি ছাউনির তলায় কাজ করতেন এককালে, পরে ওই মহল্লাতেই ছোট্ট একটি মসজিদের কাছে দোকান পেতেছিলেন, কয়েকবার তো নিজেদের তিন-কামরার বাড়িটাই পরিণত হয়েছিল দোকানে – একটা গোটা কামরা একাই দখল করে নিত চুল্লিটা। তখন আশপাশ থেকে মাটি কেটে আনা, তারপর সেটা চেলে-টেলে ছাঁচে ফেলা, এসব আজিমের স্ত্রী নাজিমা বেগমই করতেন একা হাতে।

মার্চ ২০২০ থেকে শুরু হয় লকডাউন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য মুরতাজা মাসিক ২,০০০ টাকার যে সরকারি ভাতাটা পেতেন, সেটার খানিক জমানো না থাকলে খেতে-পরতেও পেতেন না। আজিমের তিন বোনেরই বিয়েথা হয়ে গেছে, নিজের নিজের সংসার সামলাতে ব্যস্ত তাঁরা। এছাড়াও এক ছোটভাই আছেন তাঁর, দু-চাকার গাড়ির একটা শোরুমে ঝালাইয়ের কাজ করেন তিনি।

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে মারা যান মুর্তুজা (আজিমের মা খাজা মারা গিয়েছেন ২০০৭ সালে)। বন্ধ হয়ে যায় ভাতা। তাই এখন যেখানে কাজ করছেন, সেই কবরস্থান লাগোয়া দোকানটি নভেম্বর ২০২০ সালে ভাড়া নেন আজিম। একটাই আশা, যদিই বেশি বেশি করে খদ্দের জোটে, তাহলে রুজিরুটির অন্তত খানিকটা সুরাহা হবে। এতকিছুর পরেও ফাঁড়া কিন্তু কাটেনি, জানালেন তিনি। কর্মশালাটি ফুটপাথের উপর, ফলত নগর প্রশাসন থেকে যে কোনো দিন গুঁড়িয়ে দিতে পারে সেটা।

বেশ কয়েকবার দেখা করতে গিয়েছিলাম আজিমের সঙ্গে, একবার গিয়ে শুনলাম যে বেগমপেটের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে টোকেনের বরাত এসেছে তার আগেরদিন।

কাজের প্রথম ধাপটি বুঝিয়ে দিলেন তিনি, রেস্টুরেন্টে কী কী খাবার মেলে না মেলে সেই অনুযায়ী ঠিক করতে হবে টোকেনের আকার – যেমন ধরুন চায়ের পেয়ালা বা মাছ। খুবই স্বাভাবিক যে বহুদিন আগে থেকেই এই জাতীয় আকারের নমুনা হিসেবে (মাস্টার টোকেন) সাদাটে ধাতু দিয়ে টোকেন বানিয়ে রেখেছেন তিনি। এবার পালা ধাপে ধাপে সেগুলো নিখুঁতভাবে নকল করার।

Left: Placing master tokens inside the mould. Centre: Stepping on the peti to compress the soil. Right: Refining the impressions, making way for the molten liquid
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
PHOTO • Sreelakshmi Prakash

বাঁদিকে: মাস্টার টোকেনগুলি বসানো হচ্ছে ছাঁচের ভিতর। মাঝখানে: পেটির উপর পা দিয়ে চেপেচুপে দুরমুশ করা হচ্ছে মাটি। ডানদিকে: তরল ধাতু ঢালা হবে, তাই নিখুঁত করে ফেলা হচ্ছে ছাঁচের উপরকার ছাপ

কাঠের তক্তার উপর একটা পেটি (ধাতুর ছাঁচ) বসিয়ে খানিক সঞ্জিরা বা সাজিমাটির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেন আজিম। "এই গুঁড়োটা না দিলে মুদ্রাগুলো বালির (মাটি) সঙ্গে আটকে যাবে," জানালেন তিনি। এবার পালা আকার অনুযায়ী বাছাই করা টোকেনগুলো একে একে তক্তার উপর সাজানোর।

তারপর মিহি করে গুঁড়ো করা মাটির সঙ্গে গুড় দিয়ে বানানো বাদামি রঙের তরল চিট মিশিয়ে পেটিটার এক-চতুর্থাংশ ভরে ফেললেন। মাটি বা বালির কোনও বিশেষ ধরন নেই, ভালো করে চেলে মোটা দানা বাদ দিলেই চলবে। নীল রঙের একটা ত্রিপলের তলায় খানিকটা কালচে মাটি-পোড়া রাখা ছিল, গতকাল যে ঢালাইয়ের কাজটা হয়েছে, এটা তারই অবশেষ। অস্থর মিট্টির (তলানির মাটি) উপর গুড় মেশানো চটচটে মিশ্রনটা ঢালা হয়ে গেলে একদম উপরের স্তরে পুরোনো সেই মাটি-পোড়াটা সাজিয়ে দিলেন আজিম।

ততক্ষণে প্রায় টইটুম্বুর হয়ে গিয়েছিল পেটিটা, তাই পা দিয়ে দুরমুশ করে মাটিটা বসাতে লাগলেন তিনি। তারপর এক ঝটকায় পুরোটা ধরে উল্টে দিলেন। দেখলাম যে বেশ ভালোভাবেই ছাপ পড়ে গেছে মুদ্রার আকারে। ছাঁচের উপর ঢাকনা চাপিয়ে পরতে পরতে ছড়িয়ে দিলেন সাজিমাটি, অস্থর মিট্টি আর মাটি-পোড়া। আবার পালা দুরমুশ করার, এতক্ষণে অবশ্য পা-দুটি তাঁর মাটি আর ভুষোকালিতে মাখামাখি।

এবার খোলা হবে পেটিটা, তার আগে অবশ্য অতিরিক্ত মাটি মুছে ফেলেছেন আজিম। নমুনার সেই মাস্টার টোকেনগুলো সযত্নে সরিয়ে ফেললেন, ফলত খোদাই সমেত তারা ছাপ রেখে গেল মাটির মিশ্রণে।

তরল অ্যালুমিনিয়াম ঢালার জন্য ছোট্ট একটা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করলেন। মাটি-পোড়ার গর্ভে তখনও আটকে ছিল গত বরাতের ছাপ – এই যেমন ধরুন অন্য কোনও খাবার দোকানের নাম – সেই কাঠির খোঁচা দিয়েই সেসব ছাপ মিটিয়ে দিলেন আজিম। পেটিটা এবার বন্ধ করে, হুড়কো এঁটে আরেকটা তক্তা বসিয়ে দিলেন উপরে। প্রস্তুতি শেষ, এবার তাহলে ঢালাইয়ের কাজ শুরু করা যেতে পারে।

Left: After he has put sanjeera powder over the cavities before pouring in the molten metal. Centre: Operating the hand blower. Right: The metal pieces kept inside the bhatti for melting
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
Left: After he has put sanjeera powder over the cavities before pouring in the molten metal. Centre: Operating the hand blower. Right: The metal pieces kept inside the bhatti for melting
PHOTO • Sreelakshmi Prakash

বাঁদিকে: তরল ধাতু ঢালার আগে ছাপের গর্তের উপর সঞ্জিরা বা সাজিমাটির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছেন আজিম। ডানদিকে: ধাতুর টুকরো গলানোর জন্য রাখা আছে ভাট্টির ভিতর

ভাট্টিতে (চুল্লি) কয়লা ভরার জন্য হস্তচালিত একটা হাপর রয়েছে। আগুনটা গনগনে হলে একটা ধাতুর পাত্রে হয় পুরানো অব্যবহৃত টোকেন কিংবা অ্যালুমিনিয়ামের টুকরো ভরে চাপিয়ে দিলেন। সেগুলো গলতে না গলতেই একখানা সাঁড়াশি দিয়ে ধরে তরল ধাতুটা ঢালতে লাগলেন পেটির মধ্যে। এমনতর বিপজ্জনক কাজ, অথচ সুরক্ষা সরঞ্জামের নামগন্ধও নেই কোথাও। "ওসবের মেলা দাম, তাছাড়া আমি তো এভাবেই কাজ করে অভ্যস্ত," বলে উঠলেন আজিম।

তরল ধাতু জমাট বাঁধতে মিনিট খানেক লাগে, তারপরেই ছাঁচ খুলে ফেলা হল। সারি দিয়ে বেরিয়ে এলো টাটকা তাজা টোকেনের দল। ধারগুলো একে একে উখো দিয়ে ঘষে নিখুঁত করে তুললেন আজিম। "ইয়ে রাহা হামারা কয়েন (এই দেখুন, কেমন মুদ্রাখানাই না বানিয়েছি)," হাতের তালুতে একখান নবজাতক টোকেন রেখে বললেন তিনি।

এর পরের ধাপটা খোদাইয়ের, খাদ্যবস্তু এবং দোকানের নাম ইংরেজিতে লিখতে হবে টোকেনের গায়ে। এ কাজের জন্য অক্ষর এবং সংখ্যা লেখা ছেনির মতো দেখতে কিছু পাঞ্চ আছে, সদ্য সদ্য ঢালাই হওয়া টোকেনের গায়ে হাতুড়ি মেরে এগুলি বসানো হয়। খোদাই-টোদাই করে একটা ব্যাচ তৈরি হয়ে গেলে আজিম এগুলো দিয়েই আবার নতুন টোকেন বানাতে থাকেন।

"কতগুলো মুদ্রা হবে [একেকটা ব্যাচে] সেটা নির্ভর করছে পেটির উপর। ১২টা আলাদা আলাদা আয়তনের পেটি আছে আমার," ঢিপি করে রাখা কাঠামোর দিকে আঙুল তুলে বললেন তিনি। মাঝারি মাপের ১৫ বাই ৯ ইঞ্চির একটা পেটি দিয়ে একসঙ্গে ৪০টার মতো টোকেন বানান আজিম। অঢেল বরাত পেলে একটানা ১০ ঘণ্টা খেটে দিনে ৬০০টা মুদ্রা বানানো তাঁর বাঁ-হাতের খেল।

Left and centre: Taking out the newly minted tokens. Right: Separating and refining the tokens and shaping them using a file
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
PHOTO • Sreelakshmi Prakash

বাঁয়ে ও মাঝখানে: সদ্য বানানো টোকেন বার করে আনা হচ্ছে; এবার সেগুলো বাচাই করে উখোর সাহায্যে নিখুঁত করে ফেলা হবে (ডানদিকে)

মাঝেমধ্যে অবশ্য এমন ধাঁচের বরাতও আসে যেটার জন্য সাদা ধাতুতে বানানো কোনও মাস্টার মুদ্রা নেই তাঁর কাছে, তখন খদ্দেরকে বলা হয় অবিকল আকৃতির (ত্রিমাত্রিক) টোকেন প্লাস্টিকে বানিয়ে নিয়ে আসতে। তবে সেটার দাম বেশ চড়া, তাই বেশিরভাগ খদ্দেরই পুরোনো ধাঁচের টোকেন কিনতে চান। (তবে এককালে যখন আজিমের আব্বা মুর্তুজা কাজ করতেন, তখন হাতে করেই নিত্যনতুন আকার ও নকশার টোকেন বানিয়ে নিতেন তিনি।)

মুহাম্মদ মোহীনের কাছ থেকে জানা গেল যে প্লাস্টিকের চাইতে ধাতুর টোকেনের দামও কম, আবার টেকসইও বটে। আজিমের গুমটি থেকে ১৩ কিমি দূরে বেগমপেটের একটি হোটেলে বেয়ারার কাজ করেন তিনি। টোকেনের দরকার পড়লে বরাতটা তিনিই দিতে আসেন। "খদ্দেররা তো হাতে করে গোনার এই প্রথাটাই পছন্দ করেন বেশি," বলছিলেন মোহীন, "একেকটা খাবারের জন্য ১০০টা করে টোকেন রাখি আমরা। ওগুলো ফুরিয়ে গেলে চট করে বোঝা যায় যে ওই খাবারটা ১০০ প্লেট বিক্রি হয়েছে। সারাদিনে কতটা আয় হল, সেটা এভাবেই হিসেব করি। বুঝতেই তো পারছেন, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমরা, এই নিয়মটা বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে।"

সাধারণত টোকেন-পিছু ৩ টাকা দাম হাঁকেন আজিম, তবে বরাতটা ১০০০ টোকেনের কম হলে সেটা বেড়ে ৪ টাকা হয়। "সবদিন তো আর বরাত জোটে না, হপ্তায় দু-তিনদিন গুটিকয় খদ্দের পায়ের ধুলো দেন," জানালেন তিনি, "আমাকেও চেনে, দোকানটার সাকিন-হদিশ সবই রাখে। কিংবা মোবাইল নং থাকলে সরাসরি ফোন করেই অর্ডার দেয়। কারোর দরকার ৩০০টা টোকেন, কারও বা ১০০০টা। রোজগারপাতির কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনও হপ্তায় মেরেকেটে ১০০০ টাকা হাতে আসে, আবার কখনও কখনও ২,৫০০ টাকাও জুটে যায়।"

বরাত তো দিল, কিন্তু টোকেন নিতে আর এলোই না, মাঝেসাঝে এমন লোকের দেখাও মেলে। ওমনই একটা বেওয়ারিশ ব্যাচ সবচাইতে উঁচু তাকে রাখা ছিল, সেটা বার করতে করতে বলে উঠলেন: "এই ১০০০ পিস মুদ্রা বানিয়েছিলাম, কিন্তু খদ্দের ব্যাটা আর নিতেই এলো না।" তবে খাটুনিটা জলে গেলেও ধাতুটা কাজে লেগে যায় ঠিকই। দিনকতক অপেক্ষা করার পর বেওয়ারিশ টোকেনের রাশি গলিয়ে আবার নতুন করে মুদ্রা বানিয়ে ফেলেন আজিম।

Left: Punching the letters on the token. Centre: One set of an order of 1,000 tokens that was not picked by a customer. Right: Azeem shows us how a batch of the tokens will be arranged inside the peti
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
Left: Punching the letters on the token. Centre: One set of an order of 1,000 tokens that was not picked by a customer. Right: Azeem shows us how a batch of the tokens will be arranged inside the peti
PHOTO • Sreelakshmi Prakash
Left: Punching the letters on the token. Centre: One set of an order of 1,000 tokens that was not picked by a customer. Right: Azeem shows us how a batch of the tokens will be arranged inside the peti
PHOTO • Sreelakshmi Prakash

বাঁদিকে: টোকেনের গায়ে পাঞ্চ দিয়ে অক্ষর বসানো হচ্ছে। মাঝখানে: এই ১০০০ টোকেনের বরাতটি খদ্দের আর নিতে আসেনি। ডানদিকে: আজিম দেখালেন কেমনভাবে পেটির ভিতর টোকেনের ব্যাচ সাজানো হয়

দু-দুটো দোকানবাড়ির ভাড়া মেটাতেই রোজগারের সিংহভাগটাই বেরিয়ে যায়, জানালেন আজিম – মসজিদের কাছের দোকানটার জন্য ৮০০ টাকা (একে তো খদ্দের জোটাতে হবে, তাছাড়া জমজমাট মহল্লা হওয়া সত্ত্বেও এমন নামমাত্র ভাড়া, এই কারণেই এই দোকানঘরটি হাতছাড়া করতে নারাজ তিনি), আর গোরস্থান লাগোয়া অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া কর্মশালাটার জন্য আরও হাজার দুই। তাঁর কথায়: "ইস্কুলের মাইনে, ভুষিমাল, বাড়ির নিত্য প্রয়োজনের হাজারো টুকিটাকি জিনিসপত্তর, মাস গেলে এসবের পিছনে আরও ৬-৭ হাজার টাকা যায় বেরোয়।" তবে হ্যাঁ, গেরস্থালির খোরাকির ভার কিছুটা হলেও তাঁর ছোটভাই সামলান।

সন্ধ্যা নামলে মোইনপুরায় তাঁর বাড়ির পানে রওনা দেন আজিম, দোকান থেকে ওই এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা। বাড়িতে আসবাবপত্র কিছু নেই বললেই চলে, প্লাস্টিকের মাদুরে ঢাকা খাঁ-খাঁ সিমেন্টের মেঝে। "আমি চাইনা আমার বাচ্চারা এ কাজ করুক। চুল্লি, জ্বলন্ত ধাতু, এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়, বড্ডো খতরনাক," বলছিলেন তিনি।

"আমি চাই ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎটা যাতে নিরাপদ হয়, তার জন্য যথাসম্ভব ভালোভাবে শিক্ষিত করে তুলবো ওদের," পাশ থেকে বলে উঠলেন আজিমের বিবি নাজিমা। আম্মার কোল আঁকড়ে বসেছিল তিন বছরের মেয়ে পুঁচকে সমীরা, বড়দা তাহির (৬) অবশ্য তখন ঘরের এক কোনায় খেলতে ব্যস্ত। কী নিয়ে খেলছিলো জানেন? খানকতন টোকেন আর ওরই মতো খুদে একটা হাতুড়ি, বেঁচে থাকতে থাকতে ঠাকুরদা বড়ো সাধ করে বানিয়ে দিয়েছিলেন নাতির জন্য।

অনুবাদ : জশুয়া বোধিনেত্র ( শুভঙ্কর দাস )

Sreelakshmi Prakash

Sreelakshmi Prakash likes to do stories on vanishing crafts, communities and practices. She is from Kerala, and works from Hyderabad.

Other stories by Sreelakshmi Prakash
Translator : Joshua Bodhinetra
bodhinetra@gmail.com

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra