ধাড়গাঁও অঞ্চলের আক্রানি তালুকে, এক গ্রীষ্মের দুপুরে, মাথায় ঘোমটা টেনে এক দল ছাগলের পিছনে ধাওয়া করছিলেন শেভন্তা তাড়ভি। ছাগলের বাচ্চা কারও খেতের মধ্যে ঢুকে গেলেই তিনি তাঁর ছোটো লাঠিটা জমিতে ঠুকে তাকে ফিরিয়ে আনেন। “ওদের উপর কড়া নজর রাখতে হয়। ছোটোগুলো খুব দুষ্টু। ওরা নানা দিকে দৌড় লাগায়,” তিনি হেসে বললেন। “ওরাই এখন আমার ছেলেমেয়ের মতো।”

নন্দুরবার জেলার হারানখুরি গ্রামের মহারাজপাড়া জনপদে তাঁর বাড়ি — সেখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে জঙ্গল অবধি তিনি হেঁটে এসেছেন। এখানে তিনি তাঁর ছাগল, চারদিকের পাখ-পাখালি আর গাছপালার মধ্যে একা এবং মুক্ত। বিয়ের পর থেকে ১২ বছর অবধি বাঁজা, অপয়া, দুষ্ট বলে যে অপবাদ আর টিটকারি তিনি সয়ে আসছেন, তার থেকে তিনি এই মুহূর্তে মুক্ত।

“যে সব পুরুষের সন্তান নেই তাদের জন্য এমন কোনও অপবাদ নেই কেন?” প্রশ্ন ছুঁড়লেন শেভন্তা।

২৫ বছর বয়সী শেভন্তার (নাম পরিবর্তিত) ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তাঁর ৩২ বছর বয়সী স্বামী রবি, খেত মজুর হিসাবে কাজ পেলে দিনে ১৫০ টাকা রোজগার করেন। অতিরিক্ত মদ খান তিনি। মহারাষ্ট্রের আদিবাসী অধ্যুষিত এই জেলায় এই দম্পতি ভিল সম্প্রদায়ভুক্ত। শেভন্তা জানালেন যে আগের রাতেও রবি (নাম পরিবর্তিত) তাঁকে মেরেছেন। “নতুন কিছু না,” ঘাড় ঝাঁকিয়ে তিনি বললেন। “আমি ওকে সন্তান দিতে পারব না। ডাক্তার বলেছেন আমার গর্ভাশয়ে দোষ আছে ফলে আমার আর বাচ্চা হবে না।”

২০১০ সালে যখন তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায় তখন ধাড়গাঁও গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে জানানো হয় যে তাঁর পলিসিস্টিক ওভারি রোগ আছে — এটাকেই শেভন্তা ত্রুটিযুক্ত গর্ভাশয় বলছেন। ১৫ বছর বয়সে তখন তিনি ছিলেন তিন মাসের গর্ভবতী।

When Shevanta Tadvi is out grazing her 12 goats near the forest in Maharajapada hamlet, she is free from taunts of being 'barren'
PHOTO • Jyoti Shinoli

মহারাজপাড়া জঙ্গলের কাছে যখন শেভন্তা তাঁর ১২টি ছাগল চরান তখন অন্তত তাঁকে ‘বাঁজা’ অপবাদ শুনতে হয় না

পলিসিস্টিক ওভারি এমন একটি হরমোন ঘটিত রোগ যেটায় প্রজনন-সক্রিয় বয়সে অনেক মহিলাই আক্রান্ত হন — এর ফলে অনিয়মিত বা দীর্ঘকালীন ঋতুস্রাব, আন্ড্রোজেন হরমোনের বর্ধিত মাত্রা, ডিম্বাশয়ের বর্ধিত আকার এবং কোষ পরিবৃত ডিম্বানু সৃষ্টি হয়। এই রোগের কারণে বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত ও অকালজাত সন্তান হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

“এই রোগ ছাড়াও, রক্তাল্পতা, সিকেল কোষ, অস্বাস্থ্য, ও যৌনরোগও মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে,” মুম্বাইয়ের ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগবিষয়ক সমিতিসমূহের সঙ্ঘ-সভানেত্রী ডঃ কোমল চভন জানালেন।

২০১০ সালের মে মাসের সেই দিনটা শেভন্তার স্পষ্ট মনে আছে — যে দিন তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায় ও পরে পিসিওএস ধরা পড়ে। চড়া রোদে তিনি জমিতে চাষের কাজ করছিলেন। “সকাল থেকেই আমার পেটে ব্যথা করছিল,” তাঁর মনে পড়ে। “আমার স্বামী আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে রাজি ছিল না তাই আমি ব্যথা অগ্রাহ্য করেই কাজ করছিলাম।” দুপুরের দিকে ব্যথা অসহ্য হয়ে গেল। “তারপরেই আমার রক্তস্রাব শুরু হল। শাড়ি ভিজে গেছিল রক্তে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না,” তিনি বললেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর অন্য খেতমজুররা তাঁকে দুই কিলোমিটার দূরে ধাড়গাঁও হাসপাতালে নিয়ে যান।

পিসিওএস ধরা পড়ার পর থেকে তাঁর জীবনটাই বদলে গেল।

তাঁর বন্ধ্যাত্বের কারণ যে শারীরিক অসুস্থতা, এ কথা শেবন্তার স্বামী বুঝতেই চান না। “কী করে বুঝবে যদি ও ডাক্তারের সঙ্গে দেখাই না করে?” প্রশ্ন করেন শেবন্তা। তাঁর স্বামী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের নামে তাঁর উপর নির্যাতন চালান — যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই। “এতো চেষ্টার পরেও যখন দেখে যে আমার আবার ঋতুস্রাব হচ্ছে তখন ও আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে (যৌন সম্পর্কের সময়ে),” বললেন শেবন্তা। আমার ভালো লাগে না (যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে),” তিনি মনের কথা প্রকাশ করেন। “খুব ব্যথা লাগে, জ্বালা করে, চুলকোয় কখনও কখনও। ১০ বছর ধরে এই চলছে। প্রথম প্রথম আমি কাঁদতাম কিন্তু এখন আর কাঁদিও না।”

বন্ধ্যাত্ব, আর সে কারণে চলতে থাকা সামাজিক লাঞ্ছনা, নিরাপত্বাহীনতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা — সবকিছুকেই তিনি এখন নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছেন। “আমি বিয়ের আগে খুব কথা বলতাম। বিয়ের পর দেখলাম আশপাশের মহিলারা বেশ মিশুকে। সবাই যখন দেখল যে বিয়ের দুবছর পরেও আমার বাচ্চা হচ্ছে না তখন তারাই  আমাকে এড়িয়ে চলা শুরু করল। তাদের সদ্যজাত সন্তানদের আমার থেকে দূরে রাখে ওরা। ওরা বলে আমি পাপী।”

Utensils and the brick-lined stove in Shevanta's one-room home. She fears that her husband will marry again and then abandon her
PHOTO • Jyoti Shinoli

শেবন্তার এক-কামরার বাড়িতে তাঁর বাসনপত্র আর ইটের তৈরি উনান। তিনি এই আশংকায় ভোগেন পাছে তাঁর স্বামী আবার বিয়ে করে তাঁকে ত্যাগ করে বসেন

কিছু বাসনপত্র আর ইটের উনান নিয়ে তাঁর এক ঘরের বাড়িতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত শেবন্তা এই আশংকায় ভোগেন পাছে তাঁর স্বামী আবার বিয়ে করে তাঁকে ত্যাগ করে বসেন। তাঁর কথায়, “আমার কোথাও যাওয়ার নেই, আমার মা-বাবা কুঁড়ে ঘরে থেকে ১০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে অন্যের খেতে কাজ করেন। আমার চার বোন নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমার স্বামীকে সমানে ‘মেয়ে দেখায়’। ও যদি আমাকে ত্যাগ করে আমি যাব কোথায়?”

দৈনিক ১০০ টাকায়, শেবন্তা বছরে ১৬০ দিন খেতমজুর হিসাবে কাজ জুটিয়ে নেন। মাসে ১,০০০—১,৫০০ টাকা যদি তিনি পান তো তাই অনেক কিন্তু সেই সামান্য রোজগারের উপরেও তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি জানান, “আমার রেশন কার্ড নেই, মাসে ৫০০ টাকা আমি খরচ করি চাল, জোয়ারের ময়দা, তেল আর লঙ্কা গুঁড়ো কিনতে। বাকি টাকা আমার স্বামী নিয়ে নেয়। ডাক্তার, ওষুধ এসব তো দূরের কথা, আমাকে ঘর-খরচাও দেয় না — চাইলেই মারে। মাঝে মাঝে যা আয় করে তা দিয়ে মদ খাওয়া ছাড়া ও আর যে কী করে আমি জানি না।”

এক সময়ে ওঁর খুব আদরের ২০টা ছাগল ছিল, কিন্তু সেগুলিকে তাঁর স্বামী একটা একটা করে বেচে দিয়েছেন —এখন পড়ে আছে মাত্র ১২টা।

নিদারুণ অর্থকষ্ট সত্ত্বেওও তিনি কিছু টাকা জমিয়ে নিজের গ্রাম থেকে ৬১ কিলোমিটার দূরে শাহাড়ে শহরে এক বেসরকারি চিকিৎসকের কাছে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন। ক্লমিফেন চিকিৎসা করে ২০১৫ আর ২০১৬ সালে দুইবার তিন মাসের জন্য ডিম্বোস্ফোটন বাড়াতে তিনি ৬,০০০ টাকা খরচ করেছেন। আমাকে তিনি বললেন, “ধাড়গাঁও হাসপাতালে তখন কোনও ওষুধ ছিল না তাই আমি আমার মায়ের সঙ্গে একটা বেসরকারি ডাক্তারখানায় গেছিলাম।”

২০১৮ সালে তিনি একই চিকিৎসা বিনামূল্যে পেয়েছেন ধাড়গাঁও গ্রামীণ হাসপাতালে কিন্তু তৃতীয়বারেও তা বিফল হয়। “এরপর আমি আর চিকিৎসার কথা ভাবিনি,” বললেন হাল ছেড়ে দেওয়া শেবন্তা। “ছাগলগুলোই এখন আমার সন্তানের মতো।”

Many Adivasi families live in the hilly region of Dhadgaon
PHOTO • Jyoti Shinoli

ধাড়গাঁওয়ের পার্বত্য এলাকায় বাস করে বহু আদিবাসী পরিবার

প্রতিটি মানুষের নিজের শরীর অনুযায়ী আলাদা আলাদা চিকিৎসা প্রয়োজন, বুঝিয়ে বললেন, ৩০ শয্যা বিশিষ্ট ধাড়গাঁও গ্রামীণ হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, ডঃ সন্তোষ পারমার — এই হাসপাতাল পার্শ্ববর্তী ১৫০টি গ্রামকে পরিষেবা দেয় ও প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৪০০ জন করে রোগী দেখে। “ক্লমিফেন সাইট্রেট, গোনাডোট্রপিন, ব্রোমোক্রিপ্টিন-এর মতো ওষুধ কারও কারও ক্ষেত্রে কাজ করে। কারও হয়তো ভিট্রো ফারটিলাইজেশন (আইভিএফ), বা ইন্ট্রাইউটেরিন ইনসেমিনেশনয়ের (আইইইউ) মতো আরও উন্নত ধরনের প্রজনন-চিকিৎসা দরকার।”

পারমার জানাচ্ছেন, শুক্রাণু গণনা, বীর্য, রক্ত এবং মূত্র পরীক্ষা এবং যৌনাঙ্গ পরীক্ষার মতো প্রাথমিক বিষয়গুলির ব্যবস্থা ধাড়গাঁও হাসপাতালে থাকলেও এখানে বন্ধ্যাত্বের উন্নত চিকিত্সা পাওয়া যায় না, এমনকি নন্দুরবার সিভিল হাসপাতালেও তার বন্দোবস্ত নেই। তিনি আরও বলেন, “তাই, সন্তানহীন দম্পতিরা মূলত বেসরকারি ক্লিনিকগুলির উপর নির্ভরশীল যেখানে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়।” হাসপাতালের একমাত্র স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ পারমারের উপর গর্ভনিরোধক পরিষেবা থেকে শুরু করে মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতকের যত্ন ইত্যাদি যাবতীয় কাজ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

হেলথ পলিসি অ্যান্ড প্ল্যানিং (স্বাস্থ্য নীতি ও পরিকল্পনা) নামের পত্রিকায় ২০০৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ভারতবর্ষের সন্তানহীনতা সংক্রান্ত তথ্যকে ‘অপ্রতুল ও পুরানো’ বলে জানাচ্ছে। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ( এনএফএইচএস-৪ ২০১৫-১৬) ৩.৬ শতাংশ মহিলাকে কখনও সন্তান জন্ম দেননি বা নিঃসন্তান হিসাবে চিহ্নিত করেছে। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সন্তানহীনতা নিবারণ ও তার চিকিৎসা বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।

শেবন্তার কথায় একই সুরই ধরা পড়ল, “জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে সরকার কন্ডোম আর গর্ভনিরোধক বড়ি পাঠায়; তাহলে সরকার কি সন্তানহীনতার জন্য এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনা?”

বারোটি রাজ্যে ২০১২-১৩ সালে সমীক্ষা করে দ্য ইন্ডিয়ান জর্নল অভ কমিউনিটি মেডিসিন যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে দেখা যাচ্ছে যে জেলা স্তরের হাসপাতালে সন্তানহীনতা নিরোধক ও তৎসংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রোগ নিরুপণ ও অন্য পরিকাঠামো থাকলেও বেশিরভাগ সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই বন্দোবস্ত নেই। ৯৪ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও ৭৯ শতাংশ সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বীর্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ৪২ শতাংশ জেলা হাসপাতালে উন্নত পরীক্ষাগার থাকলেও এই ব্যবস্থা আছে মাত্র ৮ শতাংশ সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। রোগনিরুপণের জন্য ল্যাপ্রোস্কোপির ব্যবস্থা আছে মাত্র ২৫ শতাংশ জেলা হাসপাতালে আর এই একই উদ্দেশ্যে হিস্টেরস্কোপির ব্যবস্থা আছে ৮ শতাংশ। ক্লমিফেন-এর মাধ্যমে ডিম্বোস্ফোটন করানো হয় ৮৩ শতাংশ আর গোনাডোট্রপিন-এর মাধ্যমে করা হয় ৩৩ শতাংশ জেলা হাসপাতালে। যে সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সমীক্ষা করা হয়েছে তার থেকে এটাও উঠে এসেছে যে সেখানকার কর্মীরা কেউই কর্মরত অবস্থায় সন্তানহীনতা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার কোনও প্রশিক্ষণ পাননি।

“চিকিৎসা না পাওয়া একটি সমস্যা বটে কিন্তু তার চেয়েও বড়ো সমস্যা গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে স্ত্রীরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকা,” বললেন ইন্ডিয়ান মেডিকাল অ্যাসোসিয়েশনের নাসিক শাখার প্রাক্তন সভাপতি, ডঃ চন্দ্রকান্ত সঙ্কলেচা। “বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করতে দরকার, উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী এবং অতি উন্নতমানের যন্ত্রাদি। সরকারের মনোযোগ যেহেতু মায়ের ও সদ্যজাত শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি, অতএব প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা সরকারি হাসপাতেলে কম খরচে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া কঠিন।”

Geeta Valavi spreading kidney beans on a charpoy; she cultivates one acre in Barispada without her husband's help. His harassment over the years has left her with backaches and chronic pains
PHOTO • Jyoti Shinoli

গীতা ভালভি খাটিয়ার উপর রাজমা শুকাতে দিচ্ছেন; তিনি তাঁর স্বামীর সাহায্য ছাড়াই বারিসপাড়ায় এক একর জমি চাষ করেন। বছরের পর বছর স্বামীর অত্যাচার সয়ে তাঁর পিঠে এবং শরীরে সারাক্ষণ ব্যথা করে

শেবন্তার গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বারিসপাড়ায় গীতা ভালভি নিজের কুঁড়েঘরের বাইরে খাটিয়ার উপর রাজমা শুকাতে দিচ্ছিলেন। ৩০ বছর বয়সী গীতার বিয়ে হয়েছিল ১৭ বছর আগে, ৪৫ বছর বয়সী, অনিয়মিত খেতমজুর সুরজের সঙ্গে। সুরজ মাত্রাতিরিক্ত মদ খান। তাঁরাও ভিল সম্প্রদায়ভুক্ত। আশা কর্মীদের লাগাতার পীড়াপীড়িতে অবশেষে ২০১০ সালে পরীক্ষা করিয়ে ধরা পড়েছে যে সুরজের (নাম পরিবর্তিত) শুক্রাশয়ে শুক্রাণুর সংখ্যা কম। এর কয়েক বছর আগে, ২০০৫ সালে তাঁরা একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন, কিন্তু এতকিছুর পরেও গীতার স্বামী আর শাশুড়ি সন্তান ধারণ করতে না পারার জন্য গীতাকেই গাল পাড়েন। “সন্তান দিতে না পারার জন্য ও আমাকে দোষ দেয়, অথচ সমস্যাটা ওর, আমার নয়। কিন্তু আমি মেয়েমানুষ, আমি তো আর কাউকে বিয়ে করে নিতে পারি না!” বললেন গীতা।

২০১৯ সালে গীতা (নাম পরিবর্তিত), এক একর জমিতে ২০ কিলোগ্রাম রাজমা আর এক কুইন্টাল জোয়ার ফলিয়েছেন। “এটা বাড়িতে খাওয়ার জন্য। আমার স্বামী নিজেদের খেতে কোনও কাজ করে না। খেতমজুরি করে যা রোজগার করে তা ও মদ খেয়ে আর জুয়া খেলেই উড়িয়ে দেয়,” দাঁতে দাঁত চেপে এই কথা বলতে গিয়ে গীতা নিজের রাগ প্রকাশ করেই ফেললেন। “ও তো বসে খায়!”

“মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলে ও আমাকে লাথি মারে, কখনও লাঠি দিয়ে মারে। স্বাভাবিক অবস্থায় ও আমার সঙ্গে কথাই বলে না,” গীতা জানালেন। এতো বছরের গৃহহিংসার ফলে গীতার সারা পিঠ, কাঁধ আর ঘাড় জুড়ে এখন ব্যথা।

“আমরা আমার দেওরের মেয়েকে দত্তক নিয়েছি কিন্তু আমার স্বামী তার নিজের সন্তান চায়, তাও আবার ছেলে, সেইজন্যে আশা দিদির কথা মতো না কন্ডোম ব্যবহার করে, না আর মদ খাওয়া ছাড়ে,” বললেন গীতা। আশা কর্মী প্রতিসপ্তাহে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে আসেন, আর গীতা যৌনমিলনকালীন ব্যথা, ক্ষত, প্রস্রাবে ব্যথা, অস্বাভাবিক শ্বেতস্রাব ও তলপেটে ব্যথা ইত্যাদি সমস্যার কথা বলেন, এবং এগুলি যেহেতু যৌন রোগ অথবা জননতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ সেহেতু তাঁর পরামর্শ গীতার স্বামী যেন কন্ডোম ব্যবহার করেন।

স্বাস্থ্যকর্মীটি গীতাকে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে বলেছেন কিন্তু গীতা সে কথা নাকচ করে দিয়েছেন। “কী লাভ এখন আর ডাক্তার দেখিয়ে, চিকিৎসা করিয়ে?” গীতার প্রশ্ন। “ওষুধে হয়তো আমার শরীরের যন্ত্রণা কমবে কিন্তু আমার স্বামী কি আমার উপর অত্যাচার করা বন্ধ করবে? মদ খাওয়া কি ছাড়বে ও?”

ডঃ পারমার জানালেন যে তিনি মাসে চার থেকে পাঁচজন প্রজননে অক্ষম দম্পতিকে দেখেন যাদের মূল সমস্যা স্বামীর অতিরিক্ত মদ্যপান হেতু বীর্যে শুক্রাণুর স্বল্পতা। তিনি বললেন, “সন্তানহীনতায় পুরুষের ভূমিকা সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকার কারণে মেয়েদের উপর চলে পাশবিক অত্যাচার, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই মেয়েরা একা আসেন। মেয়েদের ঘাড়ে সব দোষ না চাপিয়ে পুরুষদের উচিত নিজেদের পরীক্ষা করানো।”

PHOTO • Jyoti Shinoli

জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার দিকে অধিক মনোযোগী হওয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সন্তানহীনতার চিকিৎসা ও এর প্রতিরোধ অবহেলিত থেকেছে। সন্তানহীনতায় পুরুষের ভূমিকা সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকার কারণে মেয়েদের উপর চলে পাশবিক অত্যাচার

পূর্ব মহারাষ্ট্রের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল, গড়চিরোলিতে তিন দশকেরও বেশি সময় জুড়ে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন ডঃ রানী বাং। তাঁর মতে সন্তানহীনতার সমস্যাটি যতটা না স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তার চেয়ে বেশি সামাজিক। “পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার অভাব একটি বড়ো সমস্যা অথচ একে শুধুই মেয়েদের সমস্যা বলে মনে করা হয়। এই মনোভাবের বদল দরকার।”

‘হেলথ পলিসি অ্যান্ড প্ল্যানিং’ প্রবন্ধটির লেখকদের মতে, “যদিও সন্তানহীনতা খুব অল্পসংখ্যক মহিলা ও দম্পতিদের সমস্যা, তবু প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এটি।” এই প্রবন্ধের মতে যদিও সন্তানহীনতার প্রধান ও অপ্রধান, কারণগুলির উৎস নারী ও পুরুষ উভয়েই তবু “মহিলারাই সন্তাহীনতাকে বেশি ভয় পান কারণ এর জন্য তাঁদের আত্মপরিচয়, সামাজিক অবস্থান ও নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাঁরা সামাজিক গ্লানি ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হন এবং সংসারে ও সমাজে তাঁদের অধিকার খর্ব হয়।”

অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়ে, ২০০৩ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে গীতার বিয়ে হয়ে যায় — একসময়ে তিনি কলেজ পাস করার স্বপ্ন দেখতেন। এখন তিনি চান তাঁর ২০ বছর বয়সী কন্যা, লতা (নাম পরিবর্তিত) তাঁর স্বপ্ন পূরণ করবে — লতা ধাড়গাঁওয়ে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন। তাঁর কথায়, “আমি ওকে পেটে ধরিনি তো কী হয়েছে, আমি চাই না ওর জীবনটা আমার মতো নষ্ট হয়ে যাক।”

একসময়ে গীতা খুব সাজগোজ করতে ভালোবাসতেন। “চুলে তেল লাগাতে, শিকাকাই দিয়ে মাথা ঘষতে, এমনিই আয়নার দিকে চেয়ে থাকতে বেশ লাগতো।” মুখে একটু পাউডার লাগাতে, সুন্দর করে চুল বাঁধতে বা গুছিয়ে শাড়ি পরতে তাঁর কোনও বিশেষ উপলক্ষ্য লাগতো না। কিন্তু বিয়ের দুবছর পরেও যখন সন্তান হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না তখন সাজগোজ করলে তাঁর স্বামী আর শাশুড়ি তাঁকে ‘নির্লজ্জ’ তকমা দিতে শুরু করলে গীতাও নিজেকে অবহেলা করা শুরু করলেন। “আমার বাচ্চা নেই বলে আমার কোনও কষ্ট নেই; এখন আমি আর নিজের সন্তান চাইও না। কিন্তু নিজেকে একটু সুন্দর করে সাজালে দোষটা কোথায়?” জানতে চান তিনি।

তাঁর সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সম্পূর্ণ হল যখন আত্মীয়স্বজন তাঁকে বিয়ে, নামকরণের মতো অনুষ্ঠান, পারিবারিক মিলনোৎসবে নিমন্ত্রণ করা বন্ধ করল। “সবাই শুধু আমার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নেমন্তন্ন করে। তারা জানে না যে আমার স্বামীর শুক্রাণু দুর্বল। আমি বাঁজা নই। একথা যদি তারা জানত তাহলে কি ওকেও নেমন্তন্ন করা বন্ধ করত?” প্রশ্ন করেন গীতা।

প্রচ্ছদ চিত্র: নিউ -মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অভিব্যক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম আর কাগজের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ

পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে zahra@ruralindiaonline.org এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন namita@ruralindiaonline.org এই আইডিতে।

বাংলা অনুবাদ : চিলকা

Jyoti Shinoli is a Senior Reporter at the People’s Archive of Rural India; she has previously worked with news channels like ‘Mi Marathi’ and ‘Maharashtra1’.

Other stories by Jyoti Shinoli
Illustration : Priyanka Borar

Priyanka Borar is a new media artist experimenting with technology to discover new forms of meaning and expression. She likes to design experiences for learning and play. As much as she enjoys juggling with interactive media she feels at home with the traditional pen and paper.

Other stories by Priyanka Borar
Editor : Hutokshi Doctor
Series Editor : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Chilka
chilkak9@gmail.com

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka