“৩২টি সংগঠনের প্রত্যেকটি-ই কোনওরকম ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছিল যুবকদের। কেউ কোনও ভাঙচুর বা মারামারি করবে না। কেউ আমাদের এই আন্দোলনের ক্ষতি করবে না, আমরা এই মর্মে আবেদন করেছিলাম। দিল্লি পুলিশের নির্দেশিত গতিপথ অনুসরণ করবে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল নিয়ে এগোব,” আমাদের এক নেতা ট্রাক্টরে বাঁধা একটি মাইক থেকে এই আবেদন করেন।

২৬শে জানুয়ারি, ৯.৪৫ নাগাদ ট্রাক্টর মিছিলের কাফিলা মুণ্ডকা শিল্পাঞ্চলের মেট্রো স্টেশন এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা আবার শুনতে পেলাম মাইকের আওয়াজ। স্বেচ্ছাসেবীরা সঙ্গে সঙ্গে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে সবাইকে দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তব্য শুনতে অনুরোধ করেন।

‘কৃষক মজুর একতা জিন্দাবাদ’ স্লোগান তুলে সকাল ৯টায় মিছিল শুরু হয় পশ্চিম দিল্লির টিকরি থেকে। ট্রাক্টর বাহিনী ছাড়াও আরও বহু আন্দোলনকারী ও স্বেচ্ছাসেবী পায়ে হেঁটে, কেউ জাতীয় পতাকা হাতে আবার কেউ নিজেদের কৃষক সংগঠনের পতাকা হাতে মিছিলে যোগ দেন। “যাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন তাঁদের আমরা ট্রাক্টরে উঠে পড়তে অনুরোধ করছি কারণ আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হবে,” নেতারা মাইকে ঘোষণা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই হাঁটা থামাননি।

মিছিল যেমন যেমন শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়েছে, মুণ্ডকা অঞ্চলে বহু মানুষ পথের ধারে বা পথবিভাজকের উপর দাঁড়িয়ে পড়েন মিছিল দেখতে। অনেকে নিজেদের মোবাইল ফোনে এই অভূতপূর্ব মিছিলের ছবি তুলে রাখেন, কেউ কেউ হাত নেড়ে স্বাগত জানান আবার কেউ বাজতে থাকা ঢোলের তালে নাচতে শুরু করেন।

মুণ্ডকার বাসিন্দাদের মধ্যে ছিলেন ৩২ বছর বয়সী বিজয় রাণা। তিনি মিছিলের উপর গাঁদা ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করতে এসেছিলেন। “রাজনৈতিক নেতাদের যদি ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো যায় তবে কৃষকদের কেন যাবে না?” তিনি প্রশ্ন তোলেন। মুণ্ডকা গ্রামে নিজের ১০ একর জমিতে তিনি গম ধান আর লাউ চাষ করেন — তিনি নিজেও একজন কৃষক। তাঁর কথায়, “কৃষকরা সেনাদের থেকে মোটেই কম না। সেনাবাহিনী যদি সীমান্ত ছেড়ে চলে যায় তাহলে যে কেউ দেশ আক্রমণ করতে পারে, তেমনই কৃষকরা না হলে সারা দেশ অনাহারে থাকবে।”

PHOTO • Satyraj Singh ,  Sanskriti Talwar

টিকরি থেকে যাওয়ার পথে (উপরের সারিতে): দুপুর নাগাদ গণ্ডগোল শুরু হয় নাঙ্গলোই চৌক এলাকায় (ছবি: সতিরাজ সিং)। নিচে বাঁদিকে: মুণ্ডকার বিজয় রাণা নামে এক কৃষক ফুল দিয়ে কৃষকদের স্বাগত জানাতে আসেন। নিচে ডানদিকে: স্বেচ্ছাসেবীরা মানবশৃঙ্খল তৈরি করে নাঙ্গলোই চৌক থেকে কৃষকদের নজাফগড় দিকে যাওয়ার পথ করে দেন (ছবি: সংস্কৃতি তলোয়ার)

ভারতবর্ষের ৭২তম সাধারণতন্ত্র দিবসে, ৩২টি কৃষক সংগঠন এবং ইউনিয়নের ডাকে এই সুবিশাল ট্রাক্টর মিছিলের যাত্রা শুরু করার কথা ছিল দিল্লি সীমান্তের তিনটি মুখ্য অঞ্চল থেকে। এগুলি হল টিকরি (পশ্চিমে), সিংঘু (উত্তর-পশ্চিমে) গাজিপুর (পূর্বে), এগুলির প্রতিটিতে, ২৬শে নভেম্বর ২০২০ থেকে কয়েক হাজার কৃষক অবস্থান করছেন তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।

সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে মোটামুটি ৭,০০০ ট্রাক্টর টিকরি থেকে রওনা দেবে। ভারতীয় কিষাণ সংঘের (একতা উগ্রহণ) তরফে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয়কারী, সিংঘারা সিং মান জানান যে টিকরি থেকে তাঁর সংগঠনের অন্তত ৬,০০০ ট্রাক্টর এই মিছিলে যোগ দিয়েছিল। অন্যদিকে, পঞ্জাব কিষাণ সংঘের রাজ্য কমিটির সদস্য, সুখদর্শন সিং নাট বলেন যে ঠিক কত ট্রাক্টর এতে যোগ দিয়েছিল তার ঠিক হিসাব দিতে তাঁরা অক্ষম। তিনি জানালেন যে তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি আরও জানান যে সকাল ৮.৪৫ নাগাদ তাঁদের ইউনিয়নের সমস্ত ট্রাক্টর টিকরিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে। ট্রাক্টরগুলি ফিরে আসটে সন্ধে ৬টা হয়ে যায়। এমতাবস্থায়, কেউ সংখ্যার হিসাব রাখতে পারেননি।

যে বৃত্তাকার পথটি পুলিশের তরফ থেকে টিকরির মিছিলের জন্য ঠিক করে দেওয়া হয় তা নাঙ্গলোই, নজফগড়, ঝরোদা কলান, কেএমপি এক্সপ্রেসওয়ে (দিল্লির পশ্চিমপ্রান্তে) হয়ে আবার টিকরি ফিরে আসে — মোট ৬৪ কিলোমিটার পথ। প্রারম্ভিক পর্বে, টিকরি, সিংঘু ও গাজিপুর থেকে যাত্রা শুরু করা মিছিলগুলির জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে তিনটি যাত্রাপথ ঠিক দেওয়া হয়। কিন্তু সিংঘারা সিং মান ঘরোয়াভাবে জানান যে প্রথমে নয়টি পথ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও পরে সংঘের নেতৃত্ব ও পুলিশের মধ্যে আলোচনাক্রমে তিনটি পথ স্থির হয়।

কিন্তু দুপুর নাগাদ নাঙ্গলোই চৌকে উড়ালপুলের ঠিক আগে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নজফগড়ের দিকে যাওয়ার জন্য ডানদিকে না ঘুরে একদল কৃষক মধ্য দিল্লি পৌঁছানোর জন্য সোজা পীরগড়ি চৌকের দিকে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। সমন্বয়কারী ও স্বেচ্ছাসেবীরা মিছিলটিকে ডানদিকে নজফগড়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।

আন্দাজ ২০ মিনিট পর ট্রাক্টর আরোহী একদল কৃষক হৈচৈ চিৎকার করে নাঙ্গলোই চৌকের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন। স্থানীয় বহু মানুষ নিজেদের ছাদ থেকে এই গোলযোগের সাক্ষী থাকেন, আবার কেউ বা নিচে নেমে আসেন দেখতে। পুলিশের তরফে এই মর্মে ঘোষণা চলতে থাকে যে তারা দুষ্কৃতিদের নিয়ন্ত্রণ করছে। অবস্থার রেকর্ড রাখতে পুলিশ বাহিনী কয়েকটি ড্রোনকেও কাজে লাগায়।

Still peacefully proceeding at Nangloi (Photos: Satyraj Singh)
PHOTO • Satyraj Singh
Still peacefully proceeding at Nangloi (Photos: Satyraj Singh)
PHOTO • Satyraj Singh

নাঙ্গলোই থেকে তখনও পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল এগিয়ে চলেছে

এই গোলযোগের মধ্যেই দিল্লি থেকে আগত গুরদয়াল সিং নামের এক স্বেচ্ছাসেবক, নাঙ্গলোইয়ে পথের ধারে তৈরি এক মঞ্চ থেকে মিছিলে অংশগ্রহণকারী সবাইকে ডানদিকে নজফগড়ের পথ ধরতে অনুরোধ করতে থাকেন। “নিজেদের দাবির কথা পৌঁছে দিতে চাইলে আমাদের সঠিক পথ ধরতে হবে (পুলিশের নির্দেশিত যাত্রাপথ)। আমি এই মিছিল শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি সবাইকে,” তিনি বলেন।

“কয়েক লক্ষ মানুষ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে আশপাশের অঞ্চল থেকেও যোগ দিয়েছিলেন। আমরা সবাইকে অনুরোধ করছিলাম শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে নির্দিষ্ট পথ ধরে এগোতে। কিন্তু সবার উপর নজর রাখা সম্ভব ছিল না,” পরে আমাকে এই কথা জানালেন টিকরি শিবিরে অবস্থানরত, পঞ্জাব কিষাণ সংঘের রাজ্য কমিটির সদস্য জসবীর কৌর নাট।

নাঙ্গলোই চৌকে দুপুরে গোলমাল হওয়া সত্ত্বেও একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল পূর্বনির্দিষ্ট পথ ধরেই এগিয়েছিল। পঞ্জাব কিষাণ সংঘ, সারা ভারত কিষাণ সভা এবং ভারতীয় কিষাণ সংঘ সহ আরও বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের ট্রাক্টরে ভরা ছিল মিছিল। বিপরীত দিক থেকে ভারতীয় কিষাণ সংঘের (একতা উগ্রহণ) আরও একটি মিছিল এসে যোগ দেয় নজফগড়ে। এরা কেএমপি এক্সপ্রেসওয়ের পথটি ধরে (টিকরি থেকে পূর্ব নির্দিষ্ট পথটি বৃত্তাকার — টিকরি থেকে নাঙ্গলোই হয়ে বা কেএমপি ধরে একই জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব)।

ট্রাক্টর করে নাঙ্গলোই-নজফগড় পথ ধরে যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন হরিয়ানার হিসার জেলার সুরেওয়ালা গ্রাম থেকা আসা ৩৫ বছর বয়সী পুনম পত্তর। তিনি সপরিবারে টিকরি এসে পৌঁছেছেন ১৮ই জানুয়ারি। সেদিন থেকে তাঁরা টিকরি সীমান্তের কাছে বাহাদুরগড়ে নিজেদের ট্রলিতেই অবস্থান করছেন। গৃহিণী পুনম জানালেন যে তিনি কেবল এই মিছিলে যোগদান করার জন্যই ট্রাক্টর চালাতে শিখেছেন।

তাঁর কথায়, “প্রতিবছর সাধারণতন্ত্র দিবসে, রাজপথে নাটক করে দেখানো হয় কৃষকরা কেমন করে খেতে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি আসলে এই রকম। এই মিছিলের মাধ্যমে কৃষকরা জানাতে চান যে তাঁরাই দেশের প্রকৃত অন্নদাতা। যতদিন এই প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে ততদিন আমি এখানেই থাকব। আরও সবাই যদি এখানে এসে যোগ দেয়, তবে তা সত্যিই প্রশংসনীয় কাজ হবে।”

পুরুষরাই বেশিরভাগ ট্রাক্টরে চালকের আসনে ছিলেন, আর মহিলারা বসেছিলেন ট্রাক্টরের ট্রলিতে। “আমরা প্রমাণ করতে এসেছি যে আমরা আদৌ সন্ত্রাসবাদী নই। মোদি সরকারকে দেখাতে চাই যে আমাদের ঐক্য কেউ ভাঙতে পারবে না,” পঞ্জাবের সাঙ্গরুর জেলার মেহলান গ্রাম থেকে আগত জসবিন্দর কৌর বললেন। তিনি নিজেও ছিলেন এমন একটি ট্রলিতে। “আমরা এখানে কালা কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। আইন রদ না হওয়া অবধি এখান থেকে নড়ব না। আমরা কারও ক্ষতি না করে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাবো।”

But then, a group of farmers in tractors broke the barricades at Nangloi chowk, amidst hooting and shouting from the occupants of some of these tractors
PHOTO • Sanskriti Talwar
But then, a group of farmers in tractors broke the barricades at Nangloi chowk, amidst hooting and shouting from the occupants of some of these tractors
PHOTO • Sanskriti Talwar

তারপর এই ট্রাক্টরগুলি থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করে একদল কৃষক নাঙ্গলোইয়ে ব্যারিকেড ভেঙে ফেললেন (ছবি: তুলেছেন সংস্কৃতি তলোয়ার)

যে তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে তিনি ও অন্যান্য কৃষকরা আন্দোলন করছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত সেই তিনটি কৃষি আইন প্রথমে অধ্যাদেশ হিসেবে পাশ হয় ৫ জুন, ২০২০, তারপর কৃষিবিল হিসেবে লোকসভায় পেশ করা হয় ১৪ই সেপ্টেম্বর এবং সেই মাসের ২০ তারিখ দ্রুততার সঙ্গে সেটিকে আইনে পরিণত করে বর্তমান সরকার। কৃষকরা যে আইনগুলির প্রতিবাদ করছেন সেগুলি হল: কৃষিপণ্য ব্যবসা – বাণিজ্য (উৎসাহ ও সুযোগসুবিধা দান) আইন, ২০২০ ; মূল্য নিশ্চয়তা ও কৃষি পরিষেবা বিষয়ে কৃষক (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি আইন, ২০২০ ; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন, ২০২০

কৃষকরা মনে করেন এই আইনগুলি তাঁদের জীবন জীবিকা ধ্বংস করে দেবে কারণ এই আইন কৃষক ও কৃষির ওপর বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থার শক্তি আরও বৃদ্ধি করবে। এছাড়াও, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য , কৃষি উৎপাদন বিপণন কমিটি, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা সহ কৃষকদের সহায়তাকারী মূল নীতিগুলিকে লঙ্ঘন করবে এই আইন। এরই পাশাপাশি, ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদকে উপেক্ষা করে ভারতীয় নাগরিকের আইনি লড়াইয়ের পথে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্যও সমালোচনার মুখে পড়েছে এই আইন।

২৬শে নভেম্বর থেকে জসবিন্দর কৌর টিকরিতে অবস্থান করছেন আর এরমধ্যে তিনি মাত্র বার দুই মেহলানে নিজের গ্রামের বাড়িতে গেছেন। তাঁর কথায়, “আমি অগস্ট থেকে প্রতিবাদে সামিল হয়েছি। প্রথমে আমরা প্রতিবাদ শুরু করি নিজেদের গ্রামে। তারপর আমরা পাতিয়ালা জেলায় যাই পাঁচ দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে। এই শীতে যখন আমার সন্তান আন্দোলন করতে বসতে পারে, তখন তার মা আর কী করে বাড়ি বসে থাকবে বলুন?” কোভিড ও শীতের কারণে শিশু ও মহিলাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার যে নির্দেশ প্রধান বিচারপতি (১১ই জানুয়ারি) জারি করেছেন তার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি এই প্রশ্ন তোলেন।

সাঙ্গরুরে তাঁর পরিবার সাত একর জমিতে শুধুমাত্র গম আর ধান চাষ করে। “আমরা আরও বিভিন্ন ধরনের ফসলও চাষ করতে পারি। কিন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কেবল ধান এবং চালের জন্যই ঠিক করা আছে। সে কারণে আমরা তার বাইরে আর অন্য কোনও ফসল চাষ করি না,” তিনি জানালেন। তাঁর মনে আছে যে একবার তাঁরা মটরশুঁটি চাষ করেছিলেন। “সেই মটরশুঁটি আমরা শেষ অবধি ২ টাকা কিলোতে বিক্রি করি। এরপর থেকে আমরা গম আর ধান ছাড়া আর কোনও ফসল চাষ করিনি। এরপর সরকার যদি ওই দুটি ফসলের জন্যও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা বন্ধ করে তাহলে আমরা যাব কোথায়?”

ওই একই ট্রলিতে ছিলেন মেহলান গ্রাম থেকেই আগত ২৪ বছর বয়সী সুখবীর সিং। গ্রামে তাঁর পরিবারের ছয় একর চাষের জমি আছে। “সরকার বলছে যে এক কুইন্টাল ভুট্টার জন্য তারা ১,৮০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আমি তো এক কুইন্টাল ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এরচেয়ে বেশি দরে কেউ বিক্রি করতে পেরেছেন কিনা গ্রামের যে কোনও মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। এই তো আমাদের অবস্থা। তার উপর সরকার যদি কোনও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা না করে তাহলে কী হবে? সেই কারণেই আমরা নিজেদের দাবি আদায় করতে পথে নেমেছি।”

ভারতীয় কিষাণ সংঘের (একতা উগ্রহণ) সদস্য, জসবিন্দর ও সুখবিন্দরের সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম তখন অন্য একটি ট্রাক্টর থেকে এসে একজন জানালেন যে তাঁদের সংঘের নেতারা সকলকে ফিরে যেতে বলছেন।

PHOTO • Sanskriti Talwar ,  Naveen Macro

উপরে বাঁদিকে: হরিয়ানার হিসার জেলার পুনম পত্তর কেবল এই মিছিলে অংশ করার জন্যই ট্রাক্টর চালাতে শিখেছেন (ছবি: সংস্কৃতি তলোয়ার)। উপরে ডানদিকে: নাঙ্গলোই নজফগড়ের পথে একটি ট্রলি থেকে জসবিন্দর কৌর জানালেন, ‘আমরা কারও ক্ষতি না করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাব’। নিচে বাঁদিকে: পঞ্জাবের সঙ্গরুর জেলার সুখবীর সিং বললেন, ‘কিছু দুষ্কৃতির জন্য আমাদের ফিরে যেতে বলা হল’। নিচে ডানদিকে: করণ সিং বললেন, ‘আমরা এখানে এসেছিলাম, তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি আদায় করতে’

২.৩০ নাগাদ যেই আমি ওঁদের ট্রলি থেকে নেমেছি অমনি দিল্লির উত্তর-পশ্চিমে ঝরোদা কালানে নিজেদের শিবিরে ফেরার জন্য তাঁরা গাড়ি একেবারে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে নিলেন। শিবিরটি নাঙ্গলোই-নজফগড় রোড থেকে আন্দাজ ১১ কিলোমিটার দূরে তখন। মিছিলটি ততক্ষণে টিকরি পেরিয়ে মোটামুটি ২৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ফেলেছে।

পূর্ব নির্দিষ্ট পথ উপেক্ষা করে নিজেদের ইচ্ছামাফিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে এমন অন্তত চারটি ট্রাক্টর আমি দুপুরের মধ্যেই দেখতে পাই। পুলিশ সে সময়ে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু দুপুর ২টোর মধ্যে যখন খবর আসতে শুরু করে যে আরও কিছু কৃষক, দলবদ্ধ অথবা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের ইচ্ছামত পথে আইটিও এবং লালকেল্লা পৌঁছাবার চেষ্টা করছেন তখন টিকরি থেকেও কয়েকটি দল লালকেল্লা যাওয়ার জন্য জেদ ধরে। সেইসময় শুরু হয় এদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। এর প্রত্যুত্তর পুলিশ দেয় লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস দিয়ে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকে বিকেল ৪.৩০ অবধি।

কেআমপি এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ থেকে নাঙ্গলোই চৌকের কাছাকাছি এসে ভারতীয় কিষাণ সংঘের (একতা উগ্রহণ) ট্রাক্টরগুলিও টিকরিতে নিজেদের শিবিরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঝরোদা কলানের শহর এলাকায় নিজের ট্রাক্টর নিয়ে যানজটে আটকে পড়েছিলেন সঙ্গরুর জেলার শেরপুর ব্লক থেকে আগত ৬৫ বছর বয়সী কানন সিং। তিনি জানালেন, “মাস দুয়েক হল আমরা পথে রয়েছি। আমরা এসেছিলাম তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার করার দাবি নিয়ে। এই কাজ সেরে তবেই আমরা পঞ্জাব ফিরব।”

আন্দোলনরত কৃষকদের যৌথ মঞ্চ, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, সন্ধে ৮টার মধ্যে এই ঘটনা থেকে নিজেদের দূরত্ব স্পষ্ট করেন ও কড়া ভাষায় এর নিন্দা করেন। “আজকের এই অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি এবং যারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ পৃথক ঘোষণা করছি। আমাদের যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন, নির্ধারিত গতিপথ উপেক্ষা করে নিন্দনীয় কাজে লিপ্ত হয়েছিল। আমাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সমাজবিরোধীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল,” ঘোষণায় বলা হয়।

“কতিপয় দুষ্কৃতির কারণে আমাদের ফিরে যেতে বলা হল,” আমাকে জানালেন সুখবীর। এরা আমাদের আপনজন না। আমরা এইসব করতে মোটেই দিল্লি আসিনি। আমরা কেবল ওই আইনগুলি প্রত্যাহার করার দাবিতে এসেছি।”

“সরকার যদি আইন প্রত্যাহার করে আমরা কালই ফিরে যাব,” বললেন, পঞ্জাব কিষাণ সংঘের রাজ্য কমিটির সদস্য, জসবীর কৌর নাট। ওই কারণেই আমরা এখানে প্রতিবাদে সামিল হয়েছি — কালা কানুনগুলি বাতিল করার দাবিতে।”

কভারচিত্র: সতিরাজ সিং

অনুবাদ: চিলকা

Sanskriti Talwar

Sanskriti Talwar is an independent journalist based in New Delhi. She reports on gender issues.

Other stories by Sanskriti Talwar
Translator : Chilka
chilkak9@gmail.com

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka