“কয়েক বছর আগে অবস্থা অন্যরকম ছিল,” শ্রীনগরের লাল চৌকে তাঁর দোকানে বসে বললেন নিয়াজ আহমেদ। পশমিনা শালের জোরদার চাহিদা ছিল ফলে নিয়াজ ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সারা ভারতে, এমন কি বিদেশেও শাল বিক্রি করে ভালো লাভ করতেন।
২০১৬ সালে আমি চাংথাঙ্গি ছাগল থেকে শুরু করে বিপণী অবধি পশমিনা শালের যাত্রাপথ অনুসরণ করতে শুরু করি; প্রাচীন বাণিজ্য পথ যা ভারত ও মধ্য এশিয়াকে যুক্ত করত তার ইতিহাসে আমার আগ্রহ। দুটি অতি মূল্যবান সামগ্রী - রেশম ও পশমিনার বাণিজ্য এই পথেই হত।
পূর্ব লাদাখের ভারত-চিন সীমান্তের কাছে তিব্বত মালভূমির পশ্চিম প্রান্তের চাংথাং অঞ্চলে চাংপা যাযাবর পশুপালকরা চাংথাঙ্গি ছাগল প্রতিপালন করেন। ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ মিটার উচ্চতায় জীবন ধারণ কষ্টকর। ভেড়া, পশমিনা ছাগল, কিছু চমরি গাইয়ের জন্য চারণভূমির সন্ধান এবং সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে মে মাস অবধি দীর্ঘ শীতকালে জীবনধারণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ, শিশুদের দেখাশোনা, রান্না, পশমিনা সুতো কাটা - দৈনিক কাজ অনেক।
প্রতিটি চাংপা পরিবারের কাছে অন্তত ৮০-১০০টা পশু থাকে – অধিকাংশেরই পশুর সংখ্যা ১০০-১৫০, কারও বা ৩০০; সাধারণত সমসংখ্যক ভেড়া এবং ছাগল। একটা চাংথাঙ্গি ছাগল থেকে প্রতি বছর গড়ে ২০০-৩০০ গ্রাম অপরিশোধিত পশম পাওয়া যায়।
বেনসেন সেরিং যখন তাঁর পশুর পাল নিয়ে হানলে ও চুমুর শহরের মাঝখানে অবস্থিত চাংথাং-এর দিকে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় ২০১৬ মার্চ মাসের এক হিমেল সকালে। তিনি বললেন লাদাখ পর্বত উন্নয়ন পর্ষদ অনুমোদিত নিখিল চাংথাং পশমিনা উৎপাদক সমবায় বিপণন সমিতি কাঁচা পশমিনা সরাসর পশুপালকদের কাছ থেকে কিনে নেয় বলে দালালরা আগের মতো তাঁদের আর ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। সমবায় সমিতি তাঁদের প্রতি কিলো কাঁচা পশমিনার জন্য ২,৫০০ থেকে ২,৭০০ টাকা দেয়। চাহিদা কমতে থাকার কারণে এই মূল্য বিগত ৪-৫ বছরে বিশেষ বাড়েনি। পঞ্জাব থেকে আসা পশমের জামাকাপড় আর পশমিনা ব্যতীত অন্য শাল বাজারে ঢুকে পড়ায় এই ব্যাবসার খুব ক্ষতি হচ্ছে।
হানলে থেকে আনুমাণিক ৪০ কিমি দূরে আমার পেমা চোকেতের সঙ্গেও দেখা হয়। পেমার ছয় সন্তানের মধ্যে তাঁর ২৩-বছর বয়সী জ্যেষ্ঠা কন্যা দেচেনই কেবল তাঁদের পারিবারিক জীবনধারা বজায় রাখতে চান। “ওই আমাদের ধারার রক্ষক,” বললেন পেমা এবং আর জানালেন যে দেচেন তাঁদের পশুগুলি আর এই পশুপালক জীবনকে খুব ভালবাসে।

কিন্তু এখন বহু চাংপা নিজেদের তাঁবু আর পশুর পাল ক্রমে বিক্রি করে অন্য পেশায় বা লেহ অঞ্চলে চলে যাচ্ছেন। পেমার জ্যেষ্ঠ পুত্র ট্রাক চালান, আরেকজন পথ নির্মাণ কাজে মোটবাহকের কাজ করেন, এক কন্যা লেহতেই কোনও অফিসে চাকরি করেন। তিনি জানালেন, “তাঁর পরিবারের যাঁরা শহরে থাকেন তাঁদের জীবন অনেক সহজ।”
লেহ-তে আমি কাশ্মিরী ব্যবসায়ীদের দেখা পেলাম যাঁরা ৮,০০০-৯,০০০ বা চাহিদা সাপেক্ষে এমনকি ২০,০০০ টাকা অবধি দিয়ে সমবায় সমিতির কাছ থেকে কাঁচা পশমিনা ক্রয় করেন। [পশমিনা] আঁশের দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে আর তা যত সরু হবে, ততো উচ্চ তার মান। আমাকে জানানো হল যে পূর্ব লাদাখের পশমিনা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়।
লেহ-তে আমার সঙ্গে মোলাকাত স্টানজিন দোলমার। “আমাদের পেশা ক্রমেই নুয়ে পড়ছে বিদ্যুৎচালিত সুতাকাটা যন্ত্রের কাছে,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন। তাঁর মনে হয় যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো দ্রুত তাঁর হাত চলে না। চিরাচরিত চরকা (স্থানীয় নাম ইয়েন্দের) যা দিয়ে আগে কাঁচা পশমিনা থেকে পশমি তন্তু বানানো হত তাকে এখন পাল্লা দিতে হয় তুলনায় অধিক উৎপাদনকারী যন্ত্রচালিত চরকার সঙ্গে, এই চরকার পেছনে খরচ করতে সক্ষম যে পরিবারগুলি তাদের হাতেই এই বিদ্যুৎচালিত চরকা রয়েছে। পুরোনো শ্রীনগরের গলিতে (মূলত নওহাট্টা ও রাইনাওয়ারি অঞ্চলে) আমি এই যন্ত্র চলার শব্দ পেতাম নিয়মিত।
একবার বোনা হয়ে গেলে পশমিনা শালগুলি হাতে রং করা হয় শ্রীনগরের কর্মশালাগুলিতে। রঞ্জনশিল্পীরা শাল প্রতি ১৫০-২০০ টাকা পান (এবং এর সঙ্গে অন্য আরও পশম বস্ত্র রাঙিয়ে মাসে ১৫,০০০-২০,০০০ টাকা উপার্জন করতে পারেন)। তারপর রাঙানো শালগুলি ধোয়ার জন্য কর্মশালা থেকে চলে যায় ঝিলম নদীর তীরে।
এরপরের ধাপ, পরম্পরাগত শিল্প প্রণালী মেনে শালগুলিতে হাতে নক্সা করা হয়। শ্রীনগর জেলার গান্দেরবাল ব্লকে এবং বারামুলা জেলার বান্দিপুর ও সোপোর তেহশিলের বহু কারিগর পশমিনা শালের উপর ছুঁচের কাজ করে জীবনধারণ করেন। উল্লিখিত স্থানগুলি ছাড়াও এমন আরও অনেক জায়গা আছে। এঁরা পশমি তন্তু ব্যবহার করে সূক্ষ্ণ নক্সা তৈরি করেন। রেশম তন্তুর বিশেষ ব্যবহার হয় না, হলে সেই শালের অর্থ মূল্যও অনেক বেশি।
“আমরা দিনে ৪-৫ ঘন্টার বেশি কাজ করতে পারি না কারণ চোখে কষ্ট হয়”, পঞ্চাশের কোঠায় বয়স নাজির আহমেদ নামের গান্দেরবালের এক কারিগর আমাকে বলেছিলেন। যেহেতু ছুঁচের কাজ সারা দিন করা যায় না সেহেতু বহু কারিগর কৃষিশ্রমিক হিসাবেও কাজ করেন। আহমেদ আমাকে বলেছিলেন যে তিনি পশমিনা পাইকারদের কাছ থেকে দিনে ২০০-৩০০ টাকা রোজগার করেন, এটা নির্ভর করে নক্সার সূক্ষ্মতার উপর। “এসব [এই কাজ] আমাদের মজ্জাগত। আমরা কম্পিউটারকেও হার মানাই...” তিনি বলেছিলেন।
তারপর হাতে কাজ করা অথবা হাতে ছাপা শালগুলি যায় শ্রীনগরের পাইকারদের কাছে, তাঁরা বিক্রি করেন শ্রীনগর ও ভারতবর্ষের আন্যান্য শহরে এবং বিদেশের খুচরো বিক্রেতাদের কাছে।
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আমি আবার দেখা করি নিয়াজ আহমেদের সঙ্গে তাঁর লাল চৌকের দোকানে। তিনি আমাকে বললেন, “শাল যত দূরে যাবে তত তার দাম বাড়বে। (শালের উপর) বেশি হাতের কাজ মানেই অধিক উৎপাদন সময় ও অধিক দাম। সারা গায়ে নক্সাদার একটি শালের দাম ১ লাখ থেকে ৫-৬ লাখ, অপরদিকে নক্সাবিহীন একটি শালের দাম হয় ১০,০০০ আর শুধু পাড় থাকলে ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা।”

এক চাংপা পশুপালক পরিবার — জাম্পা চোকে, সেরিং দোলমা, ও তাঁদের কন্যা সোনাম ন্যিদন — হানলে থেকে প্রায় ৮০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে চাংথাং-এ।

পাথুরে চড়াই কঠিন পথ বেয়ে বেনসেন সেরিং তাঁর ছাগলগুলিকে দক্ষিণ-পূর্ব চাংথাং-এ চরতে নিয়ে যান। ঘাস কতটা পাওয়া যাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে দিনে ৬-৮ ঘন্টা ছাগলগুলি চরে। অধিকাংশ পশুপালক পরিবারের ১০০-১৫০টি পশু থাকে, তাদের সব একসাথেই চরতে নিয়ে যাওয়া হয়


মাকে জড়িয়ে ধরে থাকা দুইদিন বয়সী একটি ভেড়ার উপর নজর রাখছেন পেমা চোকেতের কন্যা দেনচেন ২০১৬-এর মার্চ মাসে, বসন্তের শুরুর দিকে। মাটির নিচে পরিখার ভিতর বড়ো পাথর পেতে, পশম আর কাঠের তৈরি ঢাকনা দিয়ে তিনি মেষশাবকগুলির জন্য উষ্ণ আশ্রয় বানিয়ে দেন। পরিবারের সকল সদস্য লক্ষ্য রাখেন যাতে সদ্যজাত শাবকগুলি এই কঠিন পরিবেশে বাঁচতে পারে, যাতে তাপমাত্রা হঠাৎ নেমে গেলে, অথবা হিম শীতল বাতাসে বা তুষারে তাদের মৃত্যু না হয়

সব ঋতুতেই মেয়েরা প্রতিদিন হাতে কাঁচা পশমিনার সুতো কাটে


বাঁদিকে : জমে যাওয়া সো মোরিরি হ্রদের উপর দিয়ে বয়ে চলা অতি শীতল বাতাসকে পাত্তা না দিয়ে কোরজোক গ্রামের সেরিং নোরজোম ও সানোহ দোলকার নিজেদের ভেড়া ও ছাগল থেকে পাওয়া পশম দিয়ে একটি গালিচা ও সোয়েটার বানিয়ে চলেছেন। ডানদিকে: তাগস্তে শহর থেকে ৬০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে স্পাঙ্গমিক গ্রামে পানগং হ্রদের তীরে সেরিং দোনদাপ ও ইয়ামা চাত —ইয়ামা গালিচা বুনছেন

স্টানজিন দোলমা ও তাঁর কন্যা ইয়েন্দের ও একটি ধার করে আনা যন্ত্রে পিছনের উঠানে বসে সুতো কাটছেন। বহু পরিবার এখনও চিরাচরিত চরকা ব্যবহার করে পশমিনার সুতো কাটা পছন্দ করে। তারা এতেই অভ্যস্ত আর এইগুলি সারানোও সহজ

লেহ-এর কিছুকিছু অঞ্চলে অল্প সংখ্যক লাদাখি মেয়েকে (চাংপা সম্প্রদায়ভুক্ত নন) যন্ত্র বসিয়ে এক জায়গায় সুতো কাটার কাজ দেওয়া হয়। এতে, তাঁরা বললেন, কাজ তাড়াতাড়ি হয় আর লাভও বেশি হয়।

লেহ-তে সাইমা ডার বললেন তিনি যন্ত্রেই সুতো কাটতে পছন্দ করেন কারণ এতে কাজ দ্রুত হয় আর তিনি সন্তানদের দেখাশুনার সময় পান। তাঁর স্বামী শ্রীনগরের হোটেলে কাজ করেন।


কয়েক দশক ধরে মোহম্মদ সিদ্দিক কোঠা ও তাঁর পুত্র ইরশাদ আহমেদ কোঠা হাতে পশমিনা শাল বুনে চলেছেন। তাঁরা বললেন যন্ত্রে বোনা শালের গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়াই কঠিন।

শ্রীনগরের নওহাট্টা অঞ্চলের কর্মশালায় সবজার আহমেদ ও জুবের ওয়ানি পরম্পরাগত রঞ্জন শিল্পী। কাজের কারণে তাঁদের ঝাঁঝালো রাসায়নিক বাষ্পের সংস্পর্শে আসতে হয় অথচ তাঁদের নিয়োগকারীরা এঁদের সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করেন না


[রং করা] হয়ে গেলে পুরোনো শ্রীনগরে ঝিলমের পারে নানা স্থানে এগুলি ধোয়া হয়।


বাঁদিকে : মধ্য ত্রিশের শবির বাট তাঁর বাবার কাছে শিখেছিলেন পশমিনায় নক্সা করা, ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি এই কাজ করে চলেছেন। যদিও এখন অনেক জায়গায় নক্সা আঁকার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করা হয় তিনি কিন্তু হাতে আঁকতেই পছন্দ করেন। ডানদিকে: হাতে খোদাই করা কাঠের টুকরো ব্যবহার করা হয় পশমিনা শালের পাড় করার জন্য। পুরোনো শ্রীনগরের বিলাল মকসুদের মতো কারিগররা একটি সাধারণ বস্ত্রকে আকর্ষণীয় শালে রূপান্তরিত করার কাজ করে গর্বিত


বাঁদিকে : ওস্তাদ কারিগর নাজির আহমেদ গন্দেরবালে পশমিনা শালে ছুঁচ-সুতো দিয়ে নক্সা তুলছেন। সারা গায়ে কাজ করা একটি শাল শেষ করতে ৬-৮ মাস অবধি লাগতে পারে, অপর দিকে সাধারণ পাড়-করা শাল করতে বড়ো জোর এক মাস লাগে। ডানদিকে: লাল চৌকের পশমিনা শালের দোকানের মালিক নিয়াজ আহমেদ কয়েক দশক ধরে এই ব্যবসায় আছেন। তিনি বললেন যে তিনি ভালো দিনও দেখেছেন যখন পশমিনার চাহিদা অনেক বেশি ছিল আর বেশি ছিল তাঁর লাভ। ৪৪ বছর বয়সী মশকুর শেখ কৈশোর বয়স থেকেই পারিবারিক পশমিনা ব্যাবসায় আছেন, এখন [শাল] বোনার থেকে সরে এসেছেন শালের পাইকারি বিক্রয়ের কাজে, অধিক উপার্জনের আশায়।