"গোল-গোলাগোল গোল-গোলাগোল ঘুরছে পাখা মাথার 'পরে, ঘুমঘুমি থুই ঘুমঘুমি থুই ঘুমোয় সোনা আলতো করে," হিন্দিতে একখান ঘুমপাড়ানি গান ধরেছিল ফাতিমা বানো, "আয় ঘুম যায় ঘুম রাঙা বিছানায়, যায় ঘুম আয় ঘুম সোনা সে ঘুমায়..." রাজাজি ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভিতর বন গুজ্জরদের বসতি, বিকেলবেলা সেখানে পড়তে বসেছিল একদল বাচ্চা, তাদের সব্বার নজর এড়িয়ে অদৃশ্য হতে চাইছিল নয় বছরের সেই পুঁচকে ছানা।
বিচিত্র এই 'ইস্কুলটি' সেদিন বসেছিল তবস্সুম বিবির বাড়ির উঠোনে। মস্ত একখান ত্রিপলের উপর জটলা পাকানো পড়ুয়ার দল, বয়স তাদের ৫ থেকে ১৩, জনাকয়েকের হাতে নোটবই। তবস্সুমের নিজের দুই সন্তানও ছিল তাদের মধ্যে, একটি মেয়ে ও একটি ছেলে; বসতির আর পাঁচজনের মতো তাঁর পরিবারও মোষ চরিয়ে দুধ বেচে দিন গুজরান করে।
কুনাউ চৌড় জনপদে ২০১৫ সাল থেকে চালু হয় এই পাঠশালাটি, সবদিন ক্লাস হয় না যদিও। হয় উঠোন, কিংবা এই ঘরেরই একটি বড়ো কামরায় সোমবার থেকে শুক্রবারের ভিতর যেকোন একটা দিন বসে পড়াশোনার আসর, চলে সকাল ৯.৩০ থেকে বেলা ১২.৩০ অবধি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কয়েকবার গিয়েছিলাম সেখানে, একদিন গিয়ে দেখি যে ১১টি মেয়ে ও ১৬টি ছেলের সামনে ওই ঘুমপাড়ানি ছড়াটি আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে ফাতিমা বানো।
শিক্ষক বলতে একদল জোয়ান বন গুজ্জর। উত্তরাখণ্ডের যমকেশ্বর ব্লকের এই বস্তিটিতে উক্ত জনজাতির ২০০টি পরিবারের বাস। শিক্ষার অভাব এখানে চিরাচরিত, আর সেটার মোকাবিলাতেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন কিছু যুবক-যুবতী। (সমাজকর্মীদের আন্দাজ অনুযায়ী এ রাজ্যের কুমায়ুন ও গাড়োয়াল অঞ্চলে আনুমানিক ৭০,০০০-১,০০,০০০ জন বন গুজ্জর জাতির মানুষ থাকেন, উত্তরাখণ্ডে তাঁদের নাম অন্যান্য অনগ্রসর জাতির তালিকায় থাকলেও তফসিলি জনজাতি রূপে স্বীকৃত হওয়ার দাবি বহুদিনের।) ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্দরমহলে যে জনপদগুলি রয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ মানুষই খড়ে ছাওয়া মাটির বাড়িতে বসবাস করেন। বনদপ্তরের হুকুম, পাকাবাড়ি বানানো চলবে না। ফলত কোথাও কোনও শৌচাগারের নামগন্ধ তো নেই-ই, উপরন্তু পানীয় জলটুকুও জংলি ঝোরার থেকে বয়ে আনতে বাধ্য হন মানুষজন।


কুনাউ চৌড় জনপদে ২০১৫ সাল থেকে চালু হয় এই 'ইস্কুল', সবদিন ক্লাস হয় না যদিও। হয় উঠোন, কিংবা বড়সড় একটি কামরার ভিতর চলে পড়াশোনা
কুনাউ চৌড় জনপদটি ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকার ভেতরে, ত্রিসীমানায় কোনও পাকা রাস্তা নেই। প্রথাগত শিক্ষার এমনতর এই-আছি-এই-নেই বুড়িছোঁয়া অবস্থার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। দুটি সরকারি ইস্কুল আছে বটে – মডেল প্রাথমিক (ক্লাস ৫ অবধি) এবং ইন্টার-কলেজ স্তরের (ক্লাস ১২ অবধি) – তবে দুটিই আনুমানিক তিন কিমি দূরে। যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় চিতাবাঘ, হাতি এবং হরিণের মতো বন্যপ্রাণী। অদূরে বয়ে চলা বীন নদীটির (গঙ্গার শাখা) নাব্যতা এমন কিছু নয় বটে, তবে সেটি না পেরোলে দুটো স্কুলের একটিতেও পৌঁছনো যায় না। জুলাই আর অগস্টে বর্ষা নামলে সে ক্ষীণতোয়া জলধারা ফুলেফেঁপে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তখন মা-বাবা সঙ্গে করে না নিয়ে গেলে ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় বাচ্চাদের।
দরকারি কাগজপত্র না থাকার কারণে অধিকাংশেরই নাম নেই ইস্কুলের খাতায়। বনাঞ্চলের জনবিরল বসতিতে যে গুজ্জর পরিবারগুলি থাকে, তাঁদের পক্ষে নথিপত্র জোগাড় করাটা বেশ প্যাঁচালো ব্যাপার। কুনাউ চৌড়ের বাবা-মায়েদের থেকে জানতে পারলাম, বেশিরভাগ বাচ্চার না আছে জন্মের শংসাপত্র (বসতিতেই জন্ম নিয়েছে যারা), না আছে কোনও আধার কার্ড। ( হাজারটা সমস্যার মোকাবিলা করে বেঁচে আছেন বন গুজ্জর মানুষেরা, ২০২১ সালের মে মাসে এই ব্যাপারে তদন্ত করতে একটি কমিটি বানানোর আদেশ দেয় উত্তরাখণ্ডের উচ্চ আদালত।)
দিনের সিংহভাগটা কেটে যাচ্ছে মোষের দেখভালে, একাধিক পরিবারের কিশোর সন্তানেরা বেঁচে আছে এভাবেই। তাদের মধ্যে জাইতুন বিবির ১০ বছরের ছেলে ইমরান আলিও রয়েছে, ছ-ছ'টা মোষের দায়-দায়িত্ব সব তারই ঘাড়ে। সরকারি প্রাথমিক ইস্কুলে ও যে নাম লেখায়নি তা নয়, ২০২১ সালের অগস্টে সে ভর্তিও হয়েছিল ক্লাস সিক্সে। অথচ শিক্ষা ঘিরে ধোঁয়াশা আজও কাটেনি তার। "৬টা বাজতে না বাজতেই উঠে পড়ি, মোষগুলোকে খাওয়াই, দুধ দোয়াই। তারপর জল খাওয়াতে নিয়ে যাই ওদের, শেষে খড়-বিচালি পেতে দিই," জানালো ইমরান। সেই দুধটুকু বিক্রি করে তার বাবা, আর মোষের দেখভাল করা থেকে গেরস্থালির যাবতীয় কাজকর্ম সব ইমরানের মা-ই সামলান একাহাতে।
ইমরানের মতো অবস্থা এখানকার অধিকাংশ বাচ্চারই, ইস্কুলের দুয়ারে ঢ্যাঁড়া কেটে ঘরোয়া কাজ সামলাতেই দিনগুলো বেরিয়ে যায়। বানো বিবি জানালেন: "বাচ্চারা না থাকলে মোষগুলোর দেখভাল করাটা বেশ চাপের। প্রাণীগুলোকে ওরাই তো জল-টল খাওয়াতে বা চরাতে নিয়ে যায়। ওরা বয়ে না আনলে চুলোয় গোঁজার মতো কাঠকুট কিসুই তো পাবো না বাড়িতে বসে।" তাঁর বড়ো ছেলে ইয়াকুব (১০) ইটার-কলেজ ইস্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে বটে, তবে দুই মেয়ে ও ছোটো ছেলের (বয়স তাদের ৫-৯ বছরের ভিতর) পড়াশোনা যা কিছু তা বস্তির সেই প্রথা-বহির্ভূত 'বিচিত্র' পাঠশালাটিতেই হয়। "লেখাপড়া করলে তবেই তো ছেলেমেয়েদের উন্নতি হবে," বানো বিবি বলছিলেন, "কিন্তু থাকি তো সেই জঙ্গলেই [তাই যাবতীয় কাজকর্ম সব করতে তো হবেই।]


দিনের সিংহভাগটা কেটে যাচ্ছে মোষের দেখভালে, একাধিক পরিবারের কিশোর সন্তানেরা বেঁচে আছে এভাবেই। এদের মধ্যে জাইতুন বিবির (বাঁদিকে) ১০ বছরের ছেলে ইমরান আলিও রয়েছে (ডানদিকে)
বহুযুগ ধরে শিক্ষার রাস্তায় অন্তরায় হয়েছিল এ সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবনধারা। তবে স্থানীয় বন অধিকার সমিতির সদস্য শারাফত আলি জানালেন যে অধিকাংশ বন গুজ্জর আর আগের মতো গ্রীষ্মকালে পশু নিয়ে সমতল ছেড়ে বেরোন না, সারাটা বছর জনপদেই বসবাস করেন। তাঁর আন্দাজ, কুনাউ চৌড়ের আনুমানিক ২০০টি পরিবারের ভিতর মোটে ৪-৫টি এমন পরিবার আছে যারা মোষ নিয়ে পাড়ি দেয় পার্বত্য অঞ্চলে (উত্তরকাশী কিংবা রুদ্রপ্রয়াগ জেলায়)।
অতিমারি, এবং ২০২০ ও ২০২১ জুড়ে চলতে থাকা অনন্ত লকডাউনের কারণে উত্তরোত্তর শিথিল হয়েছে শিক্ষার এই ক্ষীণ সুযোগটুকুও। "লকডাউনের জন্য আমাদের ইস্কুলটা [সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়] বন্ধ হয়েই পড়ে আছে। এখন আমারা নিজেরাই নিজেদের মতন করে [তথা বসতির সেই 'নিয়ম-ভাঙা' পাঠশালায়] পড়াশোনা করি," ২০২০ সালে ইমরান জানিয়েছিল আমাকে।
২০২০ সালের মার্চে লকডাউন জারি হওয়া সত্ত্বেও বাড়িতে বসে পড়াশোনা করার রেওয়াজটা কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েনি। মোহাম্মদ শামশাদ জানালেন: "বাচ্চাদের নোটবইয়ে পড়া লিখে ৩-৪ দিন পরপর সেগুলো দেখেও দিতাম, আবার [কারও না কারও বাড়িতে ৩-৪টি বাচ্চাকে একত্রিত করে] নতুন নতুন জিনিসও শেখাতাম।" শামশাদ, মোহাম্মদ মীর হামজা (২৬) এবং আফতাব আলি (২০) – এঁরাই সেই 'প্রথা-বিমুখ' পাঠশালার শিক্ষকবৃন্দ।
২০১৭ সালে জনাকয় যুবক-যুবতীর সঙ্গে মিলে বন গুজ্জর আদিবাসী যুব সংগঠন তৈরি করেছিলেন তাঁরা – আজ উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ছয়জন মহিলা সহ ১৭৭ জন সদস্য রয়েছেন এই সংগঠনে। নিজ নিজ জনজাতির জন্য শিক্ষা তথা বন-অধিকার নিয়ে লড়ছেন তাঁরা। দূরত্ব-শিক্ষার আওতায় সমাজকর্ম নিয়ে মাস্টার্স করছেন হামজা, দেরাদুন কলেজ থেকে বিকম করেছেন শামশাদ, এবং সরকারি সেই ইন্টার-কলেজ ইস্কুল থেকে ক্লাস ১২ পাশ করেছেন আফতাব। বসতির আর পাঁচজনের মতো তাঁদের পরিবারগুলিও মোষ চরিয়ে বেঁচে আছে।


বাঁদিক: বহুযুগ ধরে শিক্ষার রাস্তায় অন্তরায় হয়েছিল এ সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবনধারা। তবে স্থানীয় বন অধিকার সমিতির সদস্য শারাফত আলি (মাঝখানে) জানালেন যে অধিকাংশ বন গুজ্জর আর আগের মতো গ্রীষ্মকালে পশু নিয়ে সমতল ছেড়ে বেরোন না। ডানদিকে: 'লেখাপড়া করলে তবেই তো ছেলেমেয়েদের উন্নতি হবে,' বানো বিবি জানালেন
শিক্ষার সড়কে গাড্ডা স্বরূপ আরেকটি কারণের কথা তুলে ধরলেন শিক্ষকেরা। বেশিরভাগ মা-বাবাই যেহেতু শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাননি কোনদিন, তাই হাজার ঝড়-ঝাপটা সামলে এভাবে পড়াশোনা করে আদৌ কোনও লাভ হবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ কাটছিল না তাঁদের।
শিক্ষিত হলেও চাকরি মেলে না চট করে, রুজিরুটির অন্যান্য পথগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে, ওদিকে বনভূমিতে একটু আধটু চাষবাস করে যে খাবেন, সে ব্যাপারেও বন গুজ্জরদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বনদপ্তর। ফলত গবাদি পশু চরিয়ে, দুধ বেচেই দিন গুজরান করে বেশিরভাগ পরিবার। পরিবার পিছু ৫-২৫টি করে গবাদি পশু রাখেন এঁরা – মূলত মহিষ এবং গুটিকয় গরু। দুধ কিনতে হৃষিকেশ (বস্তি থেকে এই শহরের দূরত্ব ১০ কিমি) থেকে ব্যবসায়ীরা আসে। কত পশু আছে তার উপর নির্ভর করছে আয়ের পরিমাণ, তবে মাস গেলে দুধ বেচে মোটামুটি ওই ২০-২৫ হাজার টাকা হাতে আসে। তবে এই টাকাটার সিংহভাগটাই বেরিয়ে যায় উপরোক্ত সেই ব্যবসায়ীদের থেকে খড়-বিচালি কিনতে বা পুরোনো কর্জ মেটাতে (এককালে এপ্রিল-সেপ্টেম্বরের পরিযানের মাসগুলোয় হুহু করে বেড়ে যেত সে ঋণের হার)।
সেই যুব সংগঠনের সভাপতি মীর হামজার আন্দাজ, এখনও অবধি কুনাউ চৌড়ের ১০ শতাংশ বাচ্চাও ধারাবাহিকভাবে প্রথাগত শিক্ষার আওতায় আসেনি। "শিক্ষা যে মৌলিক একটা অধিকার, এ নিয়ে অজস্র আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও যেহেতু আমাদের বস্তিটা কোনও গ্রাম পঞ্চায়েতের ভিতর পড়ছে না [যেটা না হলে যোজনাভিত্তিক সুযোগ সুবিধা আদায় করা যায় না এ দেশে], সেহেতু শিক্ষামূলক সরকারি যোজনার একটিও আমাদের দোরগোড়ায় এসে ওঠেনি," বলে উঠলেন তিনি। কুনাউ চৌড়ের অধিবাসীরা আজ বহুদিন ধরে করদায়ক গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লড়ছেন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা বন গুজ্জর বাচ্চারা যাতে প্রথাগত শিক্ষার মুখ দেখতে পারে, সে জন্য ২০১৫-১৬ নাগাদ বিনামূল্যে ও আবশ্যিক শিশু-শিক্ষা আইনের (২০০৯) আওতায় কুনাউ চৌড়ের মতো বেশ কিছু বসতিতে অনাবাসিক বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এনআরএসটিসি) গড়ে উঠেছে।


বসতির সেই প্রথা-বহির্ভূত ইস্কুলটিতে যাঁরা পড়ান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদ শামশাদ (বাঁদিকে) ও মোহাম্মদ মীর হামজা
যমকেশ্বরের ব্লক শিক্ষা আধিকারিক শৈলেন্দ্র আমোলির বক্তব্য অনুযায়ী উক্ত শিক্ষাবর্ষে কুনাউ চৌড়ের ৩৮ জন বাচ্চা অনাবাসিক বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ক্লাস করতে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে আরেকটি অনুমোদন পাওয়ার পর আবারও ক্লাস শুরু হয় জুন থেকে, সেই দিনটা থেকে ২০২০ সালের মার্চে লকডাউন শুরু হওয়া অবধি ইস্কুলের খাতায় নাম লিখিয়েছিল ৯২ জন বাচ্চা। শৈলেন্দ্র জানালেন, ২০২১-২২ সালের শিক্ষাবর্ষেও ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী ৬৩ জন বাচ্চা পড়াশোনা করার অনুমোদন পেয়েছে এনআরএসটিসিতে।
তবে তিনি একথাটাও বললেন যে এতকিছুর পরেও প্রথাগত শিক্ষার ব্যাপারে বন গুজ্জর জাতির মানুষেরা উদাসীন। ২০১৫-১৬ সালে যে বাচ্চারা নাম লিখিয়েছিল এনআরএসটিসিতে, তাদের মধ্যে অনেকেই ২০২১-২২ সালে ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু এটি যে শুধুই একটি সাময়িক ব্যবস্থা, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই কোনও।
কিন্তু এনআরএসটিসিতে (২০১৫-১৬ এবং ২০১৯এ) পড়াশোনার আদৌ যে কোনও ধারাবাহিকতা ছিল না, এটা হলফ করে জানালেন হামজা সহ অন্যান্য স্থানীয় শিক্ষকেরা। দূর-দূরান্তের গ্রাম এবং ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আসার ফলে স্থানীয় রীতি-রেওয়াজ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না সেখানকার শিক্ষকবৃন্দ, উপরন্তু হামেশাই অনুপস্থিত থাকতেন তাঁরা।
আমোলি বলছিলেন, এনআরএসটিসির নিয়ম অনুসারে যে সব জনপদ বা গ্রামে উক্ত যোজনাটি চালু হয়েছে, সেখানকার স্থানীয় তথা শিক্ষিত যুব সমাজের হাতেই মাসিক ৭,০০০ টাকা বেতন সমেত তুলে দেওয়ার কথা পড়ানোর দ্বায়িত্ব। কিন্তু ২০১৫-১৬ সালে যখন ক্লাস শুরু হয় কুনাউ চৌড়ে, তখন সেখানে এমন কেউই ছিল না যিনি নিদেনপক্ষে স্নাতক স্তরটুকু পাশ করেছেন, ফলত শিক্ষক রূপে নিযুক্ত হন দূরের গ্রাম থেকে আসা এক ব্যক্তি। আজকের দৃশ্যটা কিন্তু অন্যরকম, মীর হামজা মাস্টার্স করছেন এবং শামশাদ ইতিমধ্যেই বিকম শেষ করে ফেলেছেন, অথচ এনআরএসটিসিতে পড়ানোর চাকরি আজও অধরা রয়ে গেছে তাঁদের।

এনআরএসটিসির খাতায় নাম লেখানো বাচ্চাদের জন্য অতিরিক্ত টিউশন রূপে চলছে 'ঘরোয়া' সে পাঠশালার ক্লাস, আর যেসব বাচ্চারা এখনও অবধি ইস্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি, তাদেরকে প্রথাগত শিক্ষায় হাতেখড়ি দিচ্ছে এই পাঠশালা
খাপছাড়াভাবেই চলতে থাকা এনআরএসটিসির ফাঁকফোঁকর ভরিয়ে তুলতে শুরু হয় 'ঘরোয়া' সে পাঠশালা। সরকারি ইন্টার-কলেজ ইস্কুলে পড়া বাচ্চাদের জন্য অতিরিক্ত টিউশনের জায়গা নিয়েছে এটি। তাছাড়া যেসব বাচ্চারা (যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে এবং যারা আজ অবধি ইস্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি, তাদের সবাইকেই) ক্লাস সিক্সে উঠতে চলেছে, তাদেরকেও ঘষেমেজে তৈরি করা হচ্ছে ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য। পাঠশালার খরচাপাতি মেটাতে বাচ্চাদের থেকে কম-বেশি ৩০-৩৫ টাকা করে নেন স্থানীয় শিক্ষকেরা, তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়।
এই যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন বেরাদরির লোকজনকে শিক্ষার মূল্য বোঝাতে, এর ফল বেশ আশাপ্রদ, জানালেন শিক্ষকেরা। গুটি গুটি পায়ে হলেও সমাজের অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসছে দিনবদলের কিরণ।
"আমরা তো চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা লিখতে-পড়তে শিখুক। জঙ্গলের জীবনটা যে বড্ডো কষ্টের," বলে উঠলেন জাইতুন বিবি, "আমাদের মতো এত খাটাখাটনি থোড়াই না সইবে ওদের? কেউই লিখতে-পড়তে জানি না আমরা। আমাদের বাচ্চাকাচ্চারাও এমন রয়ে যাক, এটা মরে গেলেও চাইব না।"
মোহাম্মদ রফির তিন সন্তান, বয়েস তাদের ৫ থেকে ১১ বছরের ভিতর, তাঁর অদম্য ইচ্ছা ওরা যেন প্রত্যেকেই শিক্ষিত হয়ে ওঠে। বড়োছেলে ইয়াকুব (১১) সরকারি ইস্কুলে পড়ে ক্লাস সেভেনে, ছোটো দুইজনের ভরসা বস্তির সেই পাঠশালা। "বাইরের জগৎটা দেখে একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, বাচ্চাদের শিক্ষিত করে তুলতেই হবে," জানালেন রফি।



পাঠশালার ক্লাসে প্রথম প্রথম মেয়েরা আসত না বললেই চলে, তবে অবস্থাটা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে, ছাত্রীদের মধ্যে রামজানো (বাঁদিকে) ও নাফীসা বানো (মাঝখানে) রয়েছে আজ। ডানদিকে: পাঠশালায় পড়তে এসেছে বন গুজ্জর জাতির সন্তান রফিক
শারাফত আলির দুই সন্তান, সাত বছরের নৌশাদ ও পাঁচ বছরের আশাও বস্তির পাঠশালায় পড়তে আসে। "আজ পাঁচ বছর হতে চলল, গরমকাল এলে গরু-মোষ নিয়ে আর চরাতে বেরোই না [পার্বত্য অঞ্চলে]," বলছিলেন তিনি, "এখানেই থাকি এখন, ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। আমরা চাই ওরা ভালোভাবে পড়তে-লিখতে শিখুক, সমাজে আর পাঁচজনের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচুক। চাকরি-বাকরি পাওয়ার অধিকার তো ওদেরও আছে।"
শামশাদ জানালেন, বন গুজ্জরদের বিভিন্ন জনপদে ফলছে তাঁদের খাটাখাটনির ফসল: "২০১৯ সালে পাঁচটা বন গুজ্জর বস্তি থেকে প্রায় ৪০ জন পড়ুয়া ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে পেরেছিল আমাদের সংগঠনের জন্য। ছেলেরা তো আছেই, তাদের সঙ্গে এবার গুটিকয় মেয়েও (তবে এখনও অব্দি কুনাউ চৌড়ের এমনটা হয়নি) ক্লাস টেনে উঠতে শুরু করেছে, কয়েকজন তো ইতিমধ্যেই ১২ ক্লাসে পৌঁছে গেছে।"
পাঠশালার ক্লাসে প্রথম প্রথম মেয়েরা আসতো না বললেই চলে। "বাবা-মায়েদের গিয়ে গিয়ে বোঝাতে লাগলাম। গত ৩-৪ বছরে পরিস্থিতিটা অনেকটাই পাল্টেছে।" চলতি শিক্ষাবর্ষে কুনাউ চৌড়ের যে পড়ুয়ারা ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে পেরেছে, তাদের মধ্যে নাম রয়েছে রামজানোর (আনুমানিক ১২ বছর বয়েস)। তার পরিবারে সে-ই প্রথম মেয়ে যে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে। ক্লাস টেন পাশ করার বড্ডো ইচ্ছে তার, নিজমুখেই শোনালো সে কথা।
এদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে নয় বছরের ফাতিমা বানোর নাম, অর্থাৎ সেই ঘুমপাড়ানি ছড়াটা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিল যে মেয়েটি। বেরাদরির অনিশ্চয়তা কাঁধে তুলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত সে-ও ডিঙোতে চলেছে সরকারি ইস্কুলের চৌকাঠ।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)