কয়েকটি গাড়ি যখন নাদসুর কাতকারিওয়াড়ির মন্দিরের সামনে এসে থামল, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বিষ্ণু ওয়াঘমারে উঁকি মেরে দেখলেন কারা এসেছে। কাতকারি ভাষায় কিছু একটা বললেন। পুরুষ মহিলা মিলিয়ে পনের জনের একটা দল বেরিয়ে এল অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে।

“ওরা এসেছে ‘একদল’ শ্রমিক নিতে। এখন দর কষাকষি করতে বসবে। আমাদের বেশিরভাগ লোকই জানে না যে এই মুকদ্দমরা [ঠিকাদার] ওদের ঠকাচ্ছে। ওরা আমাদের শোষণ করে, তা সত্ত্বেও আমরা ওদের জন্য আবার কাজ করতে যাই। আমি অবশ্য কখনই ভাট্টি-তে যাই না,” বললেন বিষ্ণু। বিষ্ণুর বয়স একুশ বছর। আশেপাশের গ্রামে খুচরো কাজ করে দিন চলে।

মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার সুধাগড় ব্লকের নাদসুর পঞ্চায়েতের একটি ছোট এলাকা নাদসুর কাতকারিওয়াড়ি। এই অঞ্চলে যে সম্প্রদায়ের বসবাস – বিশেষ দুর্বল উপজাতীয় তালিকাভুক্ত কাতকারি আদিবাসী – সেই সম্প্রদায়ের মানুষ প্রত্যেক বছর দীপাবলীর পর, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি, অন্য জায়গায় চলে যান। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, চিপলুন, অমরাবতী, আর মহারাষ্ট্রের অন্যন্য কিছু জায়াগার ভাটিতে কাজ করেন এঁরা। জুন মাসের প্রথম দিকে তাঁরা আবার এখানে ফিরে আসেন। এই ভাটিগুলিতে বাবুল গাছের কাঠ দিয়ে কয়লা তৈরি হয়। সেই কয়লা বারবিকিউ আর তন্দুর করতে – অর্থাৎ মাংস ঝলসাতে – রেস্তোরাঁতে ব্যবহার করা হয়।

যে সমস্ত লরিতে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়, সেগুলি মহারাষ্ট্রের ভেতরের ভাটিগুলিতে পৌঁছতে ১৮ ঘন্টা, এবং অন্যান্য প্রদেশের ভাটিগুলিতে পৌঁছতে ৩৮ ঘন্টা মত সময় নেয়। ভাটিগুলির কাছে কাতকারি সম্প্রদায়ের মানুষ খোলা মাঠে খড়, বাঁশ, আর আখের অবশেষ দিয়ে লডঝড়ে বাসস্থান তৈরি করেন। বিদ্যুৎ এবং শৌচাগার ছাড়াই এখানে থাকতে হয়। তার ওপর সর্বক্ষণ আছে বন্য প্রাণী আর সাপের ভয়।

Group of People standing
PHOTO • Karishma V.

[ ওপরে ] অনেক কাতকারি ইঁটভাটাতে কাজ করেন; আবার অনেকে কয়লাভাটিতে কাজ করেন যেখানে বাবুল গাছের কাঠ দিয়ে কয়লা তৈরি হয়। এই কয়লা বিভিন্ন রেস্তোরায় মাংস ঝলসানোর কাজে ব্যবহৃত হয়

বাবুল গাছগুলি সাধারণত হয় জঙ্গলের ভিতর। সেই জমির মালিক ওই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ। ঠিকাদারেররা এঁদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেন যে বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করার বদলে তাঁদের খেতের জমি পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। শ্রমিকরা বাবুল কাঠ কাটেন, ভাটি তৈরি করেন, বালি ঢালেন, তারপর কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন। তারপর সেই কয়লা লরিতে বোঝাই করতে হয়। জমি থেকে সব গাছ সাফ হয়ে গেলে, তাঁরা সেই জমি পরিষ্কার করে চাষযোগ্য করে তোলেন।

ওই একই পঞ্চায়েতের থানালে কাতকারিওয়াড়ির বাসিন্দা, ৩৬ বছর বয়সী সন্দীপ পাওয়ার জানালেন, “মুকদ্দমরা প্রথমেই ২০০০০-৪০০০০/- টাকা দিয়ে দেয়।” টাকার পরিমাণ ভাটির অবস্থান এবং কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে। আর নির্ভর করে দরদামের ওপর। “কাজের জন্য আগাম এত টাকা পাওয়া যাচ্ছে দেখেই আমাদের লোকেদের লোভ হয়। মাঝেমধ্যে, যদি বাড়িতে বিয়ে থাকে, তাহলে মুকদ্দমরা একটি পরিবারকে ৮০,০০০/- টাকা অব্দি দিতে পারে।”

ভাটিগুলিতে স্বামী-স্ত্রীকে একসাথে একটি শ্রম-একক হিসেবে ধরা হয়। পরিবারের অন্য যে সদস্যরা ঘর ছেড়ে আসেন, তাঁরা বস্তা টানতে বা অন্য কোনও কাজে সাহায্য করেন। এতে কাজের গতি বাড়ে, কিন্তু তাঁরা আলাদা কোনো টাকা পান না। এছাড়াও ঠিকাদারেরা প্রত্যেক পরিবার-পিছু খাবার এবং রেশন-বাবদ সর্বাধিক ৪০০/- টাকা করে দেন – অর্থাৎ সাত মাসে ১২,০০০/- টাকা। এই টাকা মজুরির অংশ হিসেবে ধরা হয়, এবং স্বামী-স্ত্রীকে কাজ করে সেটা শোধ করতে হয়।

কঠোর পরিশ্রমের কাজ। সকাল ৭টায় শুরু হয়ে অন্তত রাত ৯টা অবধি চলে। কাছাকাছি কোনও বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কেনার জন্য সপ্তাহে একদিন ছুটি। শশীকান্ত ওয়াঘমারে পুণে জেলার খেদ তালুকের একটি ভাটিতে কাজ করেন। তিনি জানালেন, “আজ মকর সংক্রান্তি। আমরা সকাল থেকে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি। অনেক সময় গভীর রাত অবধি আমরা লরিতে কাঠ বা কয়লা বোঝাই করি।”

কঠোর পরিশ্রমের কাজ। সকাল ৭টায় শুরু হয়ে অন্তত রাত ৯টা অবধি চলে। শশীকান্ত ওয়াঘমারে পুণে জেলার খেদ তালুকের একটি ভাটিতে কাজ করেন। তিনি জানালেন, ‘আজ মকর সংক্রান্তি। আমরা সকাল থেকে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি। অনেক সময় গভীর রাত অবধি আমরা লরিতে কাঠ বা কয়লা বোঝাই করি’

ঠিকাদারেরা জানাচ্ছেন, মরশুমের শেষে কত বস্তা ভরা হয়েছে তা হিসেব করে, আগাম টাকা বাদ দিয়ে মজুরি দেওয়া হয়। মঙ্গেশ রাঠোড় একজন ঠিকাদার যিনি সেদিন ওই অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি থাকেন ২৮০ কিলোমিটার দূরে, আহমেদনগরে। রাঠোড় বলছেন, “একটা বস্তাতে ২৫ কিলো কয়লা ধরে। বস্তা-পিছু একজন শ্রমিক [স্বামী-স্ত্রী] ১২০/- টাকা পান।”

অমরাবতী জেলার দরিয়াপুর তালুকের ভাটিখানার ঠিকাদার নবনাথ চভন জোর দিয়ে বললেন যে বস্তা-পিছু এই দর মেনে চলা হয়। ২০১৮ সালে নাদসুর কাতকারিওয়াড়ির ৩৬টি পরিবার থেকে শ্রমিকরা দরিয়াপুরের ভাটিতে কাজ করতে এসেছিলেন। “আমরা আগাম টাকা দিই। একেক বস্তা কয়লার জন্য একেকটি পরিবারকে ১২০/- টাকা দেওয়া হয়। যতক্ষণ না আগাম শোধ করতে পারছে, ততক্ষণ তারা আমাদের কাছে কাজ করতে বাধ্য। যদি এক মরশুমে এর থেকে বেশি বস্তা বোঝাই করতে পারে, তাহলে রেশনের টাকা কেটে নিয়ে বস্তা-পিছু বাড়তি টাকা দেওয়া হয়।”

মোটের উপর ভালো মরশুমে একটি শ্রমিক পরিবার সর্বোচ্চ ১০০০টি বস্তা বোঝাই করতে পারে – অর্থাৎ ১২০,০০০ টাকা উপার্জন। গড়ে একেকটি পরিবার অন্তত ৫০০টি বস্তা ভরে, যার থেকে (আগাম এবং রেশনের টাকা বাদ দিয়ে) ৬০০০০/- টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু সাধারণত, মরশুম শেষ হলে, পরিবারগুলি কোনও বাড়তি টাকা পায় না। নাদসুর কাতকারিওয়াড়ি এবং থানালে কাতকারিওয়াড়ি মিলিয়ে যে ৪০টি পরিবারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তাদের কেউই মনে করতে পারলেন না যে তাঁদের বস্তা-পিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকেই জানালেন যে প্রতি মরশুমে তাঁরা সবাই ৫০০ থেকে ৭০০ বস্তা কয়লা বোঝাই করেন, কিন্তু কেউই মরশুমের শেষে কোনও বাড়তি টাকা পাননি।

৩২ বছরের সঙ্গীতা ওয়াঘমারে বাবুল কাঠের ভাটিখানায় নিয়মিত কাজ করেন। তিনি বলছেন, “একটা বিয়ে উপলক্ষ্যে আমরা ৭০,০০০/- টাকা আগাম নিয়েছিলাম। আমরা কাজ করে সেই টাকা আর রেশনের টাকা শোধ করেছি।” তার মানে, আন্দাজ ৮২,০০০/- টাকা, বা প্রায় ৭০০ বস্তা। সঙ্গীতা আর তাঁর স্বামী সেইবার ১০০০টি বস্তাতে কয়লা ভরেছিলেন। আমি তাঁকে হিসেব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে বাড়তি ৩০০ বস্তার জন্য তাঁরা ঠিকাদারের থেকে আরও ৩৮,০০০/- টাকা পেয়েছিলেন কিনা। তিনি হেসে বললেন, “উনি আমাদের একটা গান শোনার যন্ত্র আর দুটো সোনার পয়সা দিয়েছেন।” উৎসাহ-প্রদানকারী এই জিনিসগুলির মূল্য ৫০০০/- টাকা।

Woman in front of television
PHOTO • Karishma V.

সঙ্গীতা ওয়াঘমারে এবং তাঁর স্বামীকে ঠিকাদার ৩৮,০০০/- দেওয়ার বদলে দুটি সোনার পয়সা আর একটি গান শোনার যন্ত্র কিনে দিয়েছেন

“যদি আগাম ৩০,০০০/- টাকা দেওয়া হয়, তাহলে যতক্ষণ না মুকদ্দম বলছে যে সেই টাকা শোধ হয়েছে, ততক্ষণ অবধি কাজ করতে হবে। যদি কোনও পরিবার একটি মরশুমে ২০০টি বস্তা ভরে, তাহলে পরের বছর কোনও মজুরি ছাড়াই তাদের কাজ করতে হয় যতক্ষণ না বাকি টাকা শোধ হচ্ছে,” জানালেন ৭৯ বছর বয়সী বাপু হিলাম, এই জনপদগুলির একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ।

যে মাসগুলিতে ভাটিখানার কাছে থাকতে হয়, সেই মাসগুলিতে কাজের চাপ সাংঘাতিক। প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট খাবার পাওয়া যায় না। যতদিনে কাতকারিরা নিজেদের গ্রামে ফিরে আসেন, তাঁদের সন্তানরা অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কোনও কোনও জেলায় অঙ্গনওয়াড়ি থেকে প্রত্যেক বছর, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে, গর্ভবতী বা সদ্য সন্তান জন্ম হয়েছে এমন মহিলা এবং ২ থেকে ৬ বছরের বাচ্চাদের জন্য বাড়িতে ডিম আর বাদামের চিক্কি দেওয়া হয়।

থানালে’র [এই পঞ্চায়েতের একটি গ্রাম যেটি আদিবাসী গ্রাম নয়] রায়গড় জেলা পরিষদ স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু মাহাদিক বলছেন, “আমাদের মোট ৪০ জন পড়ুয়া আছে যাদের মধ্যে ২০ জন কাতকারি পরিবারের। অক্টোবরের পর এই বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের সাথে অন্য প্রদেশে চলে যায়। আবার জুন মাসে ফিরে আসে। এই কয়েক মাস তারা ওই জায়গার কোনও সরকারি স্কুলে পড়ে না। যখন ফিরে আসে তখন তাদের পরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয় কারণ সরকারি স্কুলে ফেল করানোর নিয়ম নেই। নবম শ্রেণীতে উঠেও তারা শুধু মূলাক্ষর আর বারাখড়ি-ই [প্রাথমিক স্তরের স্বাক্ষরতা] জানে। বেশির ভাগই নবম শ্রেণীতে অনুত্তীর্ণ হয়ে স্কুল ছেড়ে দেয়।”

থানালের মত অঞ্চলে অ-কাতকারি পরিবারের অনেকেরই জমি রয়েছে। বর্ষাকালের পর সেই জমিতে ছোলা এবং শিম-জাতীয় তরকারির চাষ হয়। অনেকে তালুকের আশেপাশে দিনমজুরের কাজ খোঁজেন। বহু পরিবারের সদস্যরাই কাছের কোনও মফস্বল বা বড় শহরে কাজ করেন।

“যদি আগাম ৩০,০০০/- টাকা দেওয়া হয়, তাহলে যতক্ষণ না মুকদ্দম বলছে যে সেই টাকা শোধ হয়েছে, ততক্ষণ অবধি কাজ করতে হবে। যদি কোনও পরিবার একটি মরশুমে ২০০টি বস্তা ভরে, তাহলে পরের বছর কোনও মজুরি ছাড়াই তাদের কাজ করতে হয় যতক্ষণ না বাকি টাকা শোধ হচ্ছে,” জানালেন ৭৯ বছর বয়সী বাপু হিলাম, এই জনপদগুলির একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ

নাদসুরে খেতমজুরদের দৈনিক মজুরি পুরুষদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩৫০/- এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ২৫০/- টাকা। “কিন্তু খেতের কাজ এখানে মরশুমে মরশুমে হয়। বর্ষাকালের পর, ধান বোনা হয়ে গেলে, গ্রামের মধ্যে আর কোনও কাজ থাকে না। আমাদের বেশিরভাগেরই নিজেদের জমি নেই। এই জন্যেই আমরা বর্ষকালের পর অন্য জায়গায় চলে যাই,” বললেন সন্দীপ।

কাতকারিরা যখন অন্য জায়গায় গিয়ে থাকতে আরম্ভ করেন, তখন ওঁদের নথিপত্র পাওয়ার প্রক্রিয়াও আরও বিলম্বিত হয়। তেহসিল দপ্তরে অনেক কাস্ট সার্টিফিকেট ফর্মে ধুলো জমছে কারণ ওগুলি জমা দেওয়ার পর পর কাতকারিরা অন্য জায়গায় চলে গেছেন, ফলত তালাথি-রা বাড়ি ঘুরে ঘুরে যে পরীক্ষা করেন সেই সময়ে কাতকারিরা উপস্থিত ছিলেন না। কাস্ট সার্টিফিকেটে সই করেন কোনও জেলার সাব-ডিভিশানাল ম্যাজিস্ট্রেট। তফসিলি উপজাতির মানুষদের সরকারি সুযোগ-সুবিধে পাওয়ার জন্য এই নথিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেহেতু বাড়ি বাড়ি ঘুরে খোঁজ নেওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার সময়ে কাতকারিরা অনুপস্থিত থাকেন, তাঁদের নাম আর কোনও তালিকাভুক্ত হয় না।

এ কথা ঠিক যে এই ছোট্ট গ্রামের মধ্যে কাজের সুযোগ কম। তবে সাত মাসের জন্য একটা অন্য জায়গায় চলে গিয়ে আদৌ কোনও লাভ হচ্ছে? যে টাকা উপার্জন করা হচ্ছে, সেটাও তো সেই সময়ে গোটা পরিবারের জন্য দেখলে বেশ কমই। “কোনও বিপদে বা খুব জরুরি দরকারে শ্রমিকরা ঠিকাদারদের থেকে যত প্রয়োজন তত টাকা আগাম নিতে পারে। এমএনরেগা-তে দৈনিক মজুরি [২০১/-] বেশি বটে, কিন্তু তা কাজের ছয়মাস পরে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি জমা পড়ে। অনেকে এখনও ২০১৫-এর টাকা পাননি!” জানালেন বিষ্ণু, যিনি কিছুদিন আগে এমএনরেগার একটি ব্লক-স্তরের সামাজিক নিরীক্ষা দলের সদস্য ছিলেন।

২০০৬ সালের বন অধিকার আইন যদি এখানে ঠিক মতো প্রয়োগ করা হয়, তাহলে কিছুটা সুরাহা হবে। নাদসুরের মোট ভোয়গলিক অঞ্চল ৫১০০ হেক্টরের মধ্যে ৩৫০০ হেক্টরেরও বেশি হল বনভূমি। কিন্তু এখানে বেশির ভাগ কাতকারিরই চাষের জমি নেই। বন অধিকার আইন তাঁদের একেকজনকে অথবা সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায়কে বনের অধিকার দিতে পারবে, যার ফলে চাষ করাও সম্ভব হবে এবং বনজ সম্পদ সংগ্রহও করা যাবে। সন্দীপ বলছেন, “আমরা অনেকেই আগে জঙ্গলে চাষ করতাম। তারপর বন আধিকারিরকরা আমাদের তাড়িয়ে দিলেন। এখন আমাদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র বনভূমির পাট্টা পেয়েছে বলে তাদের আর অন্যত্র যেতে হচ্ছে না।”

Man walking
PHOTO • Karishma V.
Man sitting
PHOTO • Karishma V.

[ বাঁদিকে ] ভাটিতে যাতে না যেতে হয় তাই সন্দীপ পাওয়ার একটি সরকারি যোজনার সাহায্যে আরও কয়েকজনের সঙ্গে একটি ভাটি চালাচ্ছে; [ডানদিকে] বিষ্ণু ওয়াঘমারে আশেপাশের গ্রামে খুচরো কাজ করেন।

সন্দীপ ২০০৯ সালের এক মরশুমের জন্য কয়লা ভাটিতে কাজ করার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আর কখনও তিনি গ্রাম ছেড়ে ওইরকম অবস্থার মধ্যে থাকবেন না। এই সিদ্ধান্তটি তিনি নিতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর বাবা হরি পাওয়ার বন অধিকার আইনের আওতায় ৩৩ গুন্ঠা (এখানে ৪০ গুন্ঠা মানে এক একর) জমি পেয়েছিলেন। সন্দীপের পরিবার জঙ্গলের আরেকটু গভীরে আরেকটি অপেক্ষাকৃত বড় জমিতে ধান, নাচানি, তরি-তরকারি, আর ফুলের চাষ করে, যদিও এই জমির স্বত্ব ওঁদের নেই।

কিন্তু থানালে কাতকারিওয়াড়ির ৬৫টি পরিবারের মধ্যে মাত্র্য ৩টি পরিবার বন অধিকার আইনের ব্যক্তি অধিকারের আওতায় জমি পেয়েছে। অনেকে জমি পাননি কারণ তাঁদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই অথবা তাঁরা এই আইনের ব্যাপারে কিছুই সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

রায়গড় জেলার পেন তালুকের সংহত আদিবাসী উন্নয়ন কার্যক্রমের দপ্তরেও আদিবাসী, বিশেষ করে কাতকারি সম্প্রদায়ের মত আদিবাসীদের জন্য আর্থিক অনুদান এবং সুযোগ সুবিধে রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল দশ জনের একটি দলকে তিনটি ভাগে ১০০ শতাংশ ভর্তুকিতে একটি ইঁটভাটা তৈরি করার জন্য ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান। “বাইরে অন্য ভাটিতে কাজ করতে যাওয়ার বদলে আমাদের এখন নিজেদেরই ভাটি আছে,” বলছেন সন্দীপ। আরও নয়জনের সঙ্গে এই ভাটি চালান সন্দীপ। মার্চ থেকে অক্টোবর – এই আট মাস কাজ করলে পরিবার-পিছু লাভ হয় ২০,০০০ টাকা। এই সময়ে, জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে, অনেকে খারিফ মরশুমের খেতের কাজও পেয়ে যান।

কিন্তু অনেক কাতকারিই এই সুযোগটির কথা জানেন না। ২০১৮ সালে সন্দীপের সাফল্যের পর, নাদসুর কাতকারিওয়াড়ি এবং ওই তালুকেরই আরেকটি ছোট জনপদ থেকে দুটি দরখাস্ত জমা পড়েছে।

কিছু কাজ পর্যটন শিল্প থেকেও পাওয়া যায়। সুধাগড় তেহসিলের পালি শহর অষ্টবিনায়কের একটি গণেশ-এর মূর্তির জন্য বিখ্যাত। তাছাড়াও একটি ঐতিহাসিক দূর্গ এবং গুহা এখানে রয়েছে। দুটি জায়গাতে যাওয়ার ক্ষেত্রেই নাদসুর পেরিয়ে যেতে হয়। “আমরা অন্যত্র যাই না কারণ এখানে খামার বাড়িগুলিতে কাজ করি। এতে পয়সা কম [পুরুষদের দিনে ২০০/- আর মহিলাদের ১৫০/-], কিন্তু অন্তত কাছাকাছি তো থাকা যায়। আর খুব প্রয়োজন হলে কিছু আগাম টাকাও পাওয়া যায়,” বললেন ৫১ বছরের ভিবা পাওয়ার। তিনি থাকেন নাদসুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বাহিরামপাড়া আদিবাসীওয়াড়িতে।

অভিবাসনের মাসে যখন আশেপাশের সমস্ত জনপদের কাতকারিরা চলে যায়, অভিবাসী কাতকারীদের সংখ্যা বিশাল, এই ছোট জনপদের ১২টি পরিবার থেকে যায় এখানেই। এঁদের মধ্যে একজন বললেন, “যদি আমাদের হাতেই সব থাকত, আমরা কোনোদিন গ্রাম ছেড়ে যেতাম না।”

বাংলা অনুবাদ: সর্বজয়া ভট্টাচার্য

Karishma V.

Karishma V. has been working as a Chief Minister’s Rural Development Fellow in Raigad district since April 2017. Her areas of interest are tribal development and women’s empowerment.

Other stories by Karishma V.
Translator : Sarbajaya Bhattacharya
sarbajaya.b@gmail.com

Sarbajaya Bhattacharya is from Kolkata. She is pursuing her Ph.D from Jadavpur University. She is interested in the history of Kolkata and travel literature.

Other stories by Sarbajaya Bhattacharya