ঘুটঘুটে অন্ধকারে, কানের পাশ দিয়ে বিকট শব্দে ছুটে যাচ্ছে একের পর এক ট্রেন। তবে পুরুষের বিষনজরের কাছে এসব তেমন কোনও ব্যাপারই নয়।

"রাত্তিরে টয়লেট বলতে আমাদের কাছে ওই রেললাইন ছাড়া আর কিছুই থাকে না," জানালো সপ্তদশী নিতু কুমারী।

দক্ষিণ-মধ্য পাটনার ইয়ারপুর মহল্লায় ৯ নং ওয়ার্ডের বস্তি কলোনিতে থাকেন নিতু। জটলা পাকানো সেই বাড়িগুলোর মাঝে রয়েছে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটা চাতাল, সারি দিয়ে কয়েকটা কল লাগানো আছে সেখানে। আপাতত ওখানে দুজন অর্ধনগ্ন পুরুষ মনের সুখে সাবান মাখতে ব্যস্ত। ডজনখানেক বাচ্চা ছেলেও রয়েছে, তারা অবশ্য জল নিয়ে খেলা করাতেই ব্যস্ত। পিচ্ছিল মেঝেতে লুটোপুটি খেতে খেতে একে অপরকে ঠেলাঠেলি করছিল তারা, দমকে দমকে উঠছিল হাসির হুল্লোড়।

মিটার পঞ্চাশেক দূরত্বে পরপর সাজানো আছে ১০টি পাকা বাথরুম – কলোনির একমাত্র শৌচালয় এগুলি। তবে প্রত্যেকটিই তালামারা, অতিমারির কারণে আজ অবধি এগুলি বস্তিবাসীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। আপাতত সেই শৌচালয়ের সিঁড়িতে একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে বসে বসে ঝিমোচ্ছিল একটি ছাগল। তার ঠিক পিছনেই স্তূপীকৃত আবর্জনার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। ব্যবহারযোগ্য একটা বাথরুম পেতে গেলে হাঁটতে হবে মিনিট দশেক। এছাড়াও আরেকটা শৌচাগার আছে, রেললাইন পেরিয়ে ইয়ারপুরের সেই অপর প্রান্তে, অবশ্য সেটাও হাঁটাপথে দশ মিনিট দূরে।

"ছেলেদের আর কি? যখন খুশি, যেখানে ইচ্ছে করে দিলেই হল। রাত হলে মেয়েরা ওই রেললাইনটাই ব্যবহার করে," বলছিল নিতু। সে কলেজে পড়ে, বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। (প্রতিবেদনে প্রত্যেকেরই নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে)। তবে তার মতে এখানকার অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে সে অনেকটাই ভাগ্যবান, কারণ দিনেরবেলায় ব্যবহার করার জন্য ২০০ মিটার দূরত্বে তার পিসির বাড়িতে একটি শৌচালয় রয়েছে।

নিতুর কথায়, "তাছাড়াও বাড়িতে দুটো কামরা আছে আমাদের, একটায় আমার ছোটো ভাইটা থাকে, অন্যটায় আমি আর মা। পিরিয়ড চলাকালীন প্যাড পাল্টানোর জন্য নিজস্ব একটা জায়গা তো রয়েছে নিদেনপক্ষে, এটাই যথেষ্ট, বেশিরভাগ মেয়ে আর মহিলাদের রাত অবধি অপেক্ষা করতে হয়, রেললাইনের অন্ধকার ঘুপচিতে গিয়ে প্যাড পাল্টে আসে সবাই।"

A public toilet block – the only one in this colony – stands unused, its handover to the community delayed by the pandemic
PHOTO • Kavitha Iyer

সাধারণে র ব্যবহা রে র জন্য কলোনির একমাত্র পাকা শৌচালয় – যদিও অতিমারির কারণে জনগণের হাতের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে এগুলি

নিতুর বাড়ি ৯ নং ওয়ার্ডের ছোটো বস্তিতে, পাশেই রয়েছে ইয়ারপুর আম্বেদকর নগরের বড়ো বস্তিটি। এখানকার বাসিন্দাদের আন্দাজ মতো সব মিলিয়ে মোট ২,০০০ পরিবার বসবাস করে বস্তিতে। পেশায় বেশিরভাগই মজুর। নিতুর পরিবারের মতো বেশ কিছু পরিবারই দুই প্রজন্ম হল পাটনা নিবাসী। অধিকাংশ বাসিন্দাই বিহারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজের খোঁজে পাটনায় এসে উঠেছেন, যদিও সে আজ বেশ কয়েক দশক আগের কথা।

ইয়ারপুর আম্বেদকর নগরের মহিলারা জানালেন যে তাঁরা বরাবরই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতেন, কিন্তু অতিমারির কারণে খোয়া গেছে রুজিরুটি, টান পড়েছে ভাঁড়ারে, তাই অনেকেই বাধ্য হয়েছেন বাড়িতে সেলাই করা কাপড়ের প্যাড ব্যবহার করতে। কথা বলার জন্য একটা মন্দিরের বারান্দায় জড়ো হয়েছিলেন সবাই। তাঁরা বলছিলেন যে কয়েকটা শৌচাগার যদিও বা আছে, তবে মেরামতি বা দেখভালের অভাবে সেগুলো ব্যবহারের অযোগ্য। তাছাড়া টিমটিমে আলোর জন্য রাতে সেখানে যাওয়া যায় না। তাই দিনরাত সেগুলো খোলা থাকলেও অন্ধকারে যাওয়া মানে উটকো বিপদ ডেকে আনা।

"একটাও টয়লেট নেই এমনটা শুধুমাত্র রেললাইনের ওপারেই দেখতে পাবেন, ওই ৯ নং ওয়ার্ডে," জানালেন ৩৮ বছরের প্রতিমা দেবী। মার্চ ২০২০ নাগাদ স্কুল বন্ধ হওয়ার আগে অবধি তিনি একটি স্কুল বাসে সহকারির ভূমিকায় কাজ করতেন, বেতন ছিল মাসে ৩,৫০০ টাকা। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে কর্মহীন হয়ে বসে আছেন তিনি। তাঁর স্বামীরও একই অবস্থা, রাঁধুনির কাজ করতেন একটি রেস্টুরেন্টে, ২০২০ সালের শেষের দিকে কাজটা খোয়া যায় তাঁর।

দুটো পয়সার মুখ দেখতে এই দম্পতি এখন বাধ্য হয়েছেন ইয়ারপুরের প্রধান সড়কে একটা ঠেলাগাড়ি লাগিয়ে সিঙ্গাড়া জাতীয় তেলেভাজা বিক্রি করতে। ভোর ৪টের সময় উঠে পড়েন প্রতিমা, একহাতে রান্নার কাজ সেরে বেরিয়ে পড়েন বাজার করতে, তারপর পালা সারাদিনে যা যা বিক্রিবাটা হবে তার জোগাড়যন্ত্রের, শেষে সবকিছু ধুয়েমুছে আবার রান্নায় বসেন তিনি। "আগে তাও দু'জন মিলে ১০-১২ হাজার টাকা রোজগার করতাম, এখন তো আর সেটা হয় না, তাই হিসেব করে খরচা করতে হয়," জানালেন তিনি। ইয়ারপুরের যে মহিলারা আপাতত স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের মধ্যে তিনিও রয়েছেন।

অতিরিক্ত মদ্যাসক্তির কারণে বছর কয়েক আগে কলেজ-পড়ুয়া নিতু তার বাবাকে হারায়। বস্তি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বোরিং রোড, সেখানেই গুটিকয় বাড়িতে রান্নার কাজ করেন নিতুর মা। এছাড়াও এদিক সেদিক ঝাড়পোঁছের কাজ করে মাস গেলে ৫-৬ হাজার টাকা হাতে আসে তাঁর।

"আমার এদিকটায় কলোনিতে জনা আটেক বা দশেক বাড়িতে টয়লেট রয়েছে, বাকিরা হয় হেঁটে হেঁটে দূর দূরান্তের সাধারণ শৌচালয়ে যায়, কিংবা ওই রেললাইনে গিয়েই কাজ সারে," বলছিল নিতু। উপরোক্ত বাড়িগুলির মধ্যে তার পিসির বাড়িটিও রয়েছে – তবে এই শৌচালয়গুলি মোটেও পোক্ত নয়, কারণ জল নিকাশির কোনও ব্যবস্থাই নেই সেখানে, কাছেপিঠে একটা নালাও নেই যেখানে জলটা গিয়ে পড়বে। "মুশকিলটা শুধু রাত্তিরগুলোকে নিয়েই। তবে এসব আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে এখন।"

The Ward Number 9 slum colony in Yarpur: 'At night, the only toilet available is the railway track'
PHOTO • Kavitha Iyer

ইয়ারপুরের ৯ নং ওয়ার্ডের কলোনি বস্তি: 'রাত্তিরে টয়লেট বলতে ওই রেললাইনটা ছাড়া আর কিছুই নেই'

রাত্তিরে রেললাইনের ধারে যাওয়ার হাজার হ্যাপা, কান খাড়া করে নিতু শোনে দূর থেকে ছুটে আসা ট্রেনের শব্দ, সাবধানে লাইনের গায়ে হাত দিয়ে টের পায় তেড়ে আসা চাকার কম্পন। তবে বছরের পর বছর ধরে এগুলো একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, ট্রেনের সময়গুলো মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেছে তার।

"ব্যাপারটা যে বিপজ্জনক তা জানি, কিন্তু অন্য কোনও উপায়ও তো নেই, সাধ করে তো আর ওখানে যাই না। এমন অনেক অনেক মেয়ে আর মহিলা আছে যারা স্যানিটারি প্যাড পাল্টাতে রেললাইনের ধারে যায়, বেছে নেয় যে জায়গাগুলো সবচাইতে অন্ধকার," জানালো সে। কাচাকাচিও সে সবসময় করা যায় এমনটা নয়, তবে মাঝেমাঝে ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ধরা থাকলে বালতি ভরে সঙ্গে নিয়ে যায় নিতু।

এই মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে পুরুষের বিষনজর ধরা পড়ে ঠিকই, তবে যৌন নিগ্রহের সম্বন্ধে কোনও কথা কিন্তু নিতু বা অন্যান্য মহিলাদের থেকে শুনিনি একবারও। তার মানে কি এটা যে ওখানে যেতে আসতে একটু হলেও নিরাপদ বোধ করেন তারা? নিতুর মতো বাদবাকি আর সবাই একই কথা বলল, একে তো ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে, তাছাড়াও উপরি সাবধানতার জন্য ওখানে দল না বেঁধে তারা যায় না কখনই।

অতিমারি চলাকালীন মাসকয়েকের জন্য নিতুর মা-ও স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নিতুর কথায়, "আমি তারপর বেশ করে বুঝিয়ে বললাম যে এটা কত জরুরি। এখন আবার কেনা শুরু করেছি। একেক সময় বেসরকারি কিছু সংস্থার থেকেও প্যাডের বান্ডিল দিয়ে যায় আমাদের। বেশিরভাগ মেয়েই ব্যবহার করা প্যাড কেন রেললাইনে বা পাবলিক টয়লেটে ফেলে রেখে আসে জানেন? কারণ হাতে একটা কাগজে মোড়া প্যাকেট নিয়ে ওভাবে সবার সামনে ডাস্টবিন খুঁজে বেড়াতে লজ্জা লাগে বড্ডো।"

তবে ঠিক সময়ে আবর্জনা বহনকারী গাড়ির দেখা পেলে নিতু নিজে কিন্তু তার ব্যবহার করা প্যাড সেখানেই ফেলে, কিংবা হেঁটে হেঁটে আম্বেদকর নগরের বড়ো বস্তিতে যায় যেখানে ময়লা ফেলার জন্য পেল্লায় একখানা ডাব্বা রয়েছে। তবে সেখানে যেতে মিনিট দশেক তো লাগেই, এক-একদিন যখন ওই সময়টুকু হাতে থাকে না তখন সে বাধ্য হয় প্যাডগুলো রেললাইনেই ফেলে রেখে আসতে।

Left: Neetu's house is located alongside the railway track. Right: Women living in the colony have to wash and do other cleaning tasks on the unpaved street
PHOTO • Kavitha Iyer
Left: Neetu's house is located alongside the railway track. Right: Women living in the colony have to wash and do other cleaning tasks on the unpaved street
PHOTO • Kavitha Iyer

বাঁদিকে: রেললাইনের গা-ঘেঁষে নিতুদের বাড়ি। ডানদিকে: কলোনির মহিলারা কাঁচা রাস্তার উপরেই কাচা-ধোয়ার কা জ সারতে বাধ্য হন

ইয়ারপুর থেকে মেরেকেটে তিন কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-মধ্য পাটনায় রয়েছে সগদ্দি মসজিদ রোড, এখানে হজ ভবনের ঠিক পিছনেই বিশালাকারের একটা খোলা নর্দমার দুই ধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচা-পাকা কুঁড়েঘর। এখানকার বাসিন্দারাও বহুযুগ আগে বাইরে থেকে এসেছিলেন কাজের খোঁজে। ছুটির সময়, অথবা বিয়েশাদি কিছু থাকলে তাঁরা বেগুসরাই, ভাগলপুর কিংবা খাগাড়িয়ায় নিজেদের দেশগাঁয়ে ফিরে যান।

এই বস্তিটির নিচের ধাপে, নর্দমার একেবারে পাশেই থাকে অষ্টাদশী পুষ্পা কুমারী। "ইয়াহাঁ তক্ পানি ভর্ যাতা হ্যায় (এইখান অবধি জল উঠে আসে)," ভরা বাদলার দিনে জলের স্তর যে কতখানি ওঠে সেটা হাতের চেটো দুটো কোমরে রেখে বোঝাচ্ছিল পুষ্পা, "নর্দমার জল ফুলেফেঁপে আমাদের ঘরদুয়ার, বাথরুম, সবকিছু ভাসিয়ে দেয়।"

আনুমানিক ২৫০টি বাড়ি রয়েছে এখানে, প্রায় প্রত্যেকেই নিজের নিজের জন্য একখানা করে শৌচাগার বানিয়ে নিয়েছেন নর্দমাটির ধার বরাবর। শৌচালয় থেকে মলমূত্র সবকিছু সোজাসুজি গিয়ে পড়ে দু'মিটার চওড়া সেই নয়ানজুলির পূতিগন্ধময় জলে।

কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকে সোনি কুমারী (২১), তার কছে জানা গেল যে এক-একবছর বর্ষাকালে এমনও হয় যে জল নামতে নামতে একটা গোটা দিন কেটে যায়, জল না নামলে শৌচালয় ব্যবহার করতে পারেন না এখানকার মানুষজন, ততক্ষণ সবকিছু চেপেচুপে বসে থাকতে বাধ্য হন তাঁরা।

সোনির বাবা খাগাড়িয়া জেলার মানুষ, পরিবারের সবাই ভূমিহীন। চুক্তির ভিত্তিতে পাটনা পৌরসংস্থায় সাফাইকর্মীর কাজ করেন। আবর্জনার গাড়িতে চেপে শহরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয় তাঁকে, তবে গলিঘুঁজির ভিতর থেকে ময়লা সংগ্রহ করে ডাব্বায় ভরার কাজটা কিন্তু তাঁকে পায়ে হেঁটেই করতে হয়। "লকডাউনের সময় টানা কাজ করেছে বাবা। ওদের [সোনির বাবা এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের] হাতে মাস্ক আর স্যানিটাইজার ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, "যা, গিয়ে কাজ কর"," জানালো বিএ দ্বিতীয় বর্ষে সদ্য পা-রাখা সোনি। কাছেই একজনের বাড়িতে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করেন ওর মা, মাস গেলে সব মিলিয়ে মোটামুটি ১২,০০০ টাকা হাতে আসে তাঁদের।

খোলা নর্দমার পাশে গজিয়ে উঠতে বাধ্য হওয়া এই যে বস্তি, এখানে প্রত্যেকের বাড়ির সামনে শুধুমাত্র সেই পরিবারের নিজেদের ব্যবহারের জন্য দাঁড়িয়ে আছে একেকটা করে শৌচাগার। "আমাদের বাথরুমটার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, জানেন। এই তো গতকালই পাদানিটা হড়কে নিচে নর্দমার জলে গিয়ে পড়েছে," বলছিল পুষ্পা। তার মা গৃহস্থালির সমস্ত কাজকর্ম একাই সামলান। ওদিকে ওর বাবা আজ বেশ কয়েক মাস হতে চলল কাজ হারিয়ে বসে আছেন বাড়িতে, তার আগে অবধি রাজমিস্ত্রি অথবা নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি।

Left: Pushpa Kumari holding up the curtain to her family's toilet cubicle. Right: In the Sagaddi Masjid Road colony, a flimsy toilet stands in front of each house
PHOTO • Kavitha Iyer
Left: Pushpa Kumari holding up the curtain to her family's toilet cubicle. Right: In the Sagaddi Masjid Road colony, a flimsy toilet stands in front of each house
PHOTO • Kavitha Iyer

বাঁদিকে: নিজেদের পরিবারের ছো ট্টো শৌচালয়টির পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পা কুমারী। ডানদিকে: সগদ্দি মসজিদ রোড কলোনি, বাড়ি গুলির র সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাঙাচোরা শৌচাগা রের সারি

শৌচালয়গুলি ছোট্টো ছোট্টো গুমটির মতো দেখতে, মূলত অ্যাসবেস্টস কিংবা টিনের পাত জুড়ে জুড়ে বানানো। জোড়াতালি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে হরেক কিসিমের জিনিস, যেমন বাঁশ, বাতিল রাজনৈতিক ব্যানার, কাঠের পাটাতন, ইট-পাটকেল ইত্যাদি। ভিতরে সামান্য উঁচু পাদানির উপর রয়েছে চিনেমাটির প্যান – অধিকাংশই হয় ভাঙাচোরা, ফুটোফাটা, কিংবা বিশ্রি বেরঙা। অনেকক্ষেত্রেই দেখলাম যে পাদানিগুলো ভেঙে তলিয়ে গেছে নয়ানজুলির জলে। শৌচালয়গুলিতে দরজার বদলে আব্রু রক্ষার কাজ করছে ধুলোভরা কাপড়ের ফালি।

সগদ্দি মসজিদ রোডের একপ্রান্তে, যেখান থেকে বস্তিটি শুরু হচ্ছে, সেখানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ইস্কুলবাড়ির সামনে যদিও বা দুটি বাথরুম আছে, কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাসে অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে ইস্কুলের মতো এগুলির দরজাতেও তালা ঝুলছে।

কাছেই পরপর কয়েকটা কল লাগানো আছে জনগণের ব্যবহার্থে, বস্তির মানুষজন এখান থেকেই তাঁদের যাবতীয় কাজের জন্য জল সংগ্রহ করে থাকেন। উপরন্তু এগুলি তাঁদের স্নানাগারও বটে। কয়েকজন মহিলা অবশ্য নিজেদের বাড়ির পিছনেই চানটান করেন, পর্দা কিংবা কোনাঘুপচি দিয়ে যতটুকু লজ্জা ঢাকা যায় আর কি। তবে আমি যে সকল মেয়ে এবং যুবতীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তাঁরা সবাই কাপড়জামা পরে ওই বাইরের কলেই স্নান করেন, তবে হ্যাঁ, সবসময়ই দল বেঁধে আসেন তাঁরা।

"কয়েকজন জল বয়ে এনে বাড়ির বাইরে কোনাঘুপচিতে কোনও মতে গা-ঢেকে স্নান করে। আসলে খানিকটা হলেও লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা যায় তো, তাই," বলছিল সোনি।

"অ্যাডজাস্ট কর্ লেতে হ্যায় (মানিয়ে নিতে শিখে গেছি)," বাইরে জনসম্মুখে স্নান করার ব্যাপারে বলছিল পুষ্পা। একগাল হাসি নিয়ে জানালো সে, "তবে কল থেকে জল ভরে বাথরুম অবধি গুটিগুটি পায়ে যখন হেঁটে আসি, তখন সব্বাই বুঝে যায় যে কী করতে যাচ্ছি!"

Left: During the monsoon, sometimes drain water recedes from the toilet after an entire day. Right: Residents use public taps, which are also bathing areas
PHOTO • Kavitha Iyer
Left: During the monsoon, sometimes drain water recedes from the toilet after an entire day. Right: Residents use public taps, which are also bathing areas
PHOTO • Kavitha Iyer

বাঁদিকে: বর্ষাকালে নর্দমার জলে শৌচাগার ভেসে গেলে কখনও কখনও তা নামতে একটা গোটা দিন কেটে যায়। ডানদিকে: জনগণের স্বার্থে বানানো এই কলগুলি ব্যবহার করেন বস্তিবাসীরা, তাঁদের স্নানের জায়গাও এটাই

এছাড়া জলের উৎস বলতে আর একটাই জিনিস আছে এখানে – বস্তির বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা চাপাকল, অর্থাৎ হ্যাণ্ডপাম্প। গৃহস্থালির হরেক কাজে – সে রান্নাবান্না হোক বা পানীয় জল – এই কলগুলিই (পাবলিক ট্যাপ এবং হ্যাণ্ডপাম্প) একমাত্র ভরসা। মেয়েরা জানালো যে এখানে কেউই জল ব্যবহার করার আগে ফুটিয়ে নেন না, যদিও ইস্কুলের শিক্ষক তথা বেসরকারি সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা বারংবার তাঁদের পানীয় জলের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করার কথা বুঝিয়েছেন।

তবে এখানকার মেয়েদের মধ্যে জনাকয়েক বাদে কেউই ঋতুস্রাব চলাকালীন কাপড়ের প্যাড ব্যবহার করে না, তাদের বেশিরভাগই স্যানিটারি ন্যাপকিনের দিকে ঝুঁকেছে। অবশ্য লকডাউনের সময়টাতে দোকানপাট বন্ধ থাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিন জোগাড় করাটা বেশ ঝকমারির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা এটাও জানালো যে তাদের মায়েরা নিজেরা সেই কাপড়ের প্যাডই ব্যবহার করেন, তবে এই বয়স্ক মহিলার দল কিন্তু নিজেদের কন্যাসন্তানের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে আনতে ভোলেন না কখনই।

ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলোর ঠাঁই হয় খোলা নর্দমার জলে। ফলত কদিন পরেই দেখা যায় যে পলিথিন কিংবা কাগজের মোড়কের মায়া ত্যাগ করে সেগুলি দিব্যি ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। "প্যাডগুলো ঠিকমতো মুড়ে কেমন করে পৌরসভার ময়লা নিয়ে যাওয়ার গাড়িতে ফেলে আসতে হয় সেটা আমাদের শেখানো (বেসরকারি সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ) হয়েছে বৈকি। তবে ছেলেগুলো সব আড়ে আড়ে চেয়ে থাকে তো, তাই সে যতই কাগজ-টাগজ দিয়ে মুড়ি না কেন, ময়লার গাড়ি অবধি হাতে প্যাড নিয়ে হেঁটে যেতে বড্ডো লজ্জা লাগে যে," অকপটে জানালো সোনি।

আমার সঙ্গে কথা বলতে স্থানীয় একটি সভাঘরে মেয়েরা সব জড়ো হয়েছিল। দমকে দমকে হাসির রোল উঠলো, ধীরে ধীরে টুকিটাকি হাজারও কাহিনি বেরিয়ে আসতে লাগল এক এক করে। "এই এই, তোদের মনে আছে গেল বর্ষায় যখন টয়লেটে জল থইথই করছিল, আমরা একটা গোটা দিন কিচ্ছুটি মুখে দিইনি যাতে বাথরুমে না যেতে হয়?" জিজ্ঞেস করল পুষ্পা।

"আমার মা-বাবাকে যাতে দুটো টাকা রোজগার করার জন্য এমন কষ্ট না করতে হয়," তাই সোনি স্নাতক স্তর পাশ করার পর চাকরি করতে চায়। সে জানায় যদিও বা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পরিষেবার অনেকটা তাঁদের হাতের নাগালে এসেছে বটে, ঠিকঠাক একটা শৌচব্যবস্থা আজও অধরাই থেকে গেছে। "বস্তিবাসী মেয়েদের জন্য টয়লেটটাই সবচাইতে বড়ো সমস্যা।"

প্রতিবেদকের বয়ান: এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় দীক্ষা ফাউন্ডেশন যে সহায়তা করেছেন, নানান তথ্য দিয়েছেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। পাটনা শহরের বিভিন্ন বস্তির মহিলা এবং বাচ্চাদের সঙ্গে শৌচব্যবস্থা তথা অন্যান্য বিষয় নিয়ে এই ফাউন্ডেশনটি (ইউএনএফপিএ ও পাটনা পৌরসংস্থার সঙ্গে ) কর্মরত।

পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।

নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে zahra@ruralindiaonline.org এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন namita@ruralindiaonline.org এই আইডিতে

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Kavitha Iyer

Kavitha Iyer has been a journalist for 20 years. She is the author of ‘Landscapes Of Loss: The Story Of An Indian Drought’ (HarperCollins, 2021).

Other stories by Kavitha Iyer
Illustration : Priyanka Borar

Priyanka Borar is a new media artist experimenting with technology to discover new forms of meaning and expression. She likes to design experiences for learning and play. As much as she enjoys juggling with interactive media she feels at home with the traditional pen and paper.

Other stories by Priyanka Borar
Editor and Series Editor : Sharmila Joshi

Sharmila Joshi is former Executive Editor, People's Archive of Rural India, and a writer and occasional teacher.

Other stories by Sharmila Joshi
Translator : Joshua Bodhinetra
bodhinetra@gmail.com

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra