উমা পাটিলের দুই কামরার ঘরে একটি লোহার আলমারির এক কোণে জমা রয়েছে এক দশকের হাতে লেখা দলিল – বড় বড় রেজিস্টার, নোটবই, ডায়রি, সার্ভে ফর্মের ফটোকপি। বিভিন্ন পলিথিন ব্যাগে ভরে একটার ওপর আরেকটা চাপানো রয়েছে।
এই ক্রমবর্ধমান স্তূপের মধ্যে ধরা আছে প্রায় সমগ্র গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের পরিসংখ্যান। এই তথ্য সংগ্রহ করেছে আশা – অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট নামক একটি কর্মী দল। এখানে রয়েছে জন্ম, শিশুদের টীকা, বয়ঃসন্ধিকালীন পুষ্টি, গর্ভনিরোধ, যক্ষ্মা ইত্যাদি নানা বিষয় সংক্রান্ত তথ্য। ২০০৯ সাল থেকে উমা এই জাবদা খাতাগুলি রেখে দিয়েছেন। রেখেছেন মহারাষ্ট্রের সাঙ্গলী জেলার অন্তর্গত মিরাজ তালুকের আরাগ গ্রামের মানুষদের জন্য। এবং বরাবর চেষ্টা করেছেন তাঁর গ্রামের মানুষদের কাছে স্বাস্থ্য-বিষয়ক তথ্য পৌঁছে দিতে এবং তাঁদের সঠিক পথে চালিত করতে।
৪৫ বছর বয়সী উমার মত আরও ৫৫,০০০ আশা কর্মী মহারাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করেন নিজেদের গ্রামে বুনিয়াদি স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করার জন্য। ২০০৫ সালের জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (এনআরএইচএম)-এর মধ্যে দিয়ে এই কর্মীদের দল গঠিত হয়। ২৩ দিন ট্রেনিং-এর পর এই স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে নিয়োগ করা হয়। প্রত্যেকেই মহিলা। এনআরএইচএম-এর নিয়ম অনুযায়ী আদিবাসী গ্রামে প্রতি ১০০০ জন পিছু একজন কর্মী (অন্তত অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়েছেন এমন) এবং অন্যান্য গ্রামে ১৫০০ জন পিছু একজন কর্মীকে (অন্তত দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এমন) নিয়োগ করতে হবে।
আরাগ বেশ বড় গ্রাম – জনসংখ্যা প্রায় ১৫,৬০০। উমা ছাড়াও আরও ১৫ জন আশা কর্মী সকাল দশটা থেকে গ্রামের বিভিন্ন দিকে চলে যান। মিরাজ তালুকাতে আরাগ-ই প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। বেদাগ, লিঙ্গনুর, খাটাভ, শিন্দেওয়াড়ি, এবং লক্ষ্মীওয়াড়ি – এই গ্রামগুলির প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আরাগ। এই গ্রামগুলি মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৭,০০০। রয়েছেন ৪১ জন আশা কর্মী।
প্রত্যেক আশা কর্মী সময় করে তাঁকে যে বাড়িগুলির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সেই প্রতিটি বাড়িতে দৈনিক বরাদ্দ পাঁচ ঘন্টার বেশি সময়ই কাটান। “যদি সব বাড়ি গ্রামের মধ্যেই হয়, তাহলে দুই ঘন্টায় ১০-১৫টা বাড়িতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু অনেকেই গ্রামের সীমান্তে বা খামারবাড়িতে থাকে। তখন চারটে বাড়ি যেতেই পাঁচ ঘন্টার বেশি সময় লাগে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ঝোপঝাড়, খামার, কাদা পেরিয়ে হেঁটে যেতে হয়। বর্ষাকালে অবস্থা আরও খারাপ হয়,” জানালেন উমা।


নথিপত্র ভরা এবং গুছিয়ে রাখা আশা কর্মীর কাজের অংশ হয়ে গেছে, এবং তাঁরা স্টেশানারি আর ফটোকপির টাকাও নিজেরা দেন, জানালেন আরাগ জেলার সাঙ্গলী গ্রামের উমা পাটিল
বাড়ি বাড়ি গিয়ে মূল কাজ হল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও গর্ভনিরোধ নিয়ে কথা বলা, সর্দিকাশি বা জ্বরের মত ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসা করা, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসব এবং স্তন্যপান করানোর জন্য তৈরি করা, নবজাতককের ওপর নজর রাখা (বিশেষত যাদের কম ওজন, বা যারা সময়ের আগে জন্মেছে), পেটের অসুখ হয়েছে বা রক্তাল্পতা এবং অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের ওপর নজর রাখা, তাদের যাতে সব টীকা দেওয়া হয় সেটা সুনিশ্চিত করা, যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়া জাতীয় অসুখ আটকানোর বা চিকিৎসার চেষ্টা করা।
কাজের কোনও শেষ নেই। “প্রত্যেকটি বাড়িতে যাতে [স্বাস্থ্য] সমীক্ষা হয় আর স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছোয় সেটি আমরা সুনিশ্চিত করি। এমনকি মরশুমি অভিবাসী এবং তাঁদের পরিবারদের ক্ষেত্রেও,” বলছেন উমা, যিনি তাঁর স্বামী অশোকের সঙ্গে তাঁদের এক একর খেতে বেবি কর্নের চাষের কাজটিও করেন।
এর বিনিময়ে মহারাষ্ট্রে একজন আশা কর্মীর এক মাসের মাইনে – সরকার একে বলে ‘ইন্সেন্টিভ’ বা ‘সাম্মানিক’ – হল গড়ে মাত্র ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা। সেটা নির্ভর করে কাজের ওপর – যেমন, প্রতি প্যাকেট নিরোধ এবং ট্যাবলেট পিছু ১ টাকা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সফল প্রসব করালে ৩০০ টাকা, নবজাতকের খেয়াল রাখতে ৪২ বার একটি বাড়িতে গেলে ২৫০ টাকা।



নথিপত্রের কাজ বিপুল এবং অফুরান : রয়েছে নোটবই , রেজিস্টার এবং বিভিন্ন নিরীক্ষার ফর্ম – এই সবই আশা কর্মীরা নিঁখুতভাবে গুছিয়ে রাখেন
উপরন্তু, এই স্তূপীকৃত নোটবইতে আশা কর্মীদের লিখে যেতে হয় প্রতিটি ভিসিট, সার্ভে, এবং পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য। উমা বলছেন, “আমি মাসে রোজগার করি ২০০০ টাকা এবং তার মধ্যে প্রায় ৮০০ টাকা খরচ করি নোটবই কিনে, জেরক্স করিয়ে, যাতায়াতে, আর মোবাইল রিচার্জ করে। প্রত্যেকটি মূল ফর্মের দুটো করে ফটোকপি নিয়ে যেতে হয়। একটা তত্ত্বাবধায়ক বা ফেসিলিটেটরকে দিতে হয়। একটা আমাদের কাছে থাকে। দুই পিঠ [ফটোকপি] করতে ২ টাকা লাগে...”
ফর্মগুলি নানা ধরনের – ‘হোম-বেস্ড নিউবর্ন কেয়ার ফর্ম’, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’র ফর্ম, শৌচালয় এবং পানীয় জল সংক্রান্ত পরিবার-ভিত্তিক সার্ভে, কুষ্ঠ সংক্রান্ত তথ্য – এরকম আরও অনেক কিছু। তারপর রয়েছে গ্রাম স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি দিবস সার্ভে যেখানে দেখা হয় কতজন অনুষ্ঠানে এসেছে, কত লেভেল হিমোগ্লোবিন মাপা হয়েছে, শিশুদের টীকা দেওয়া, অপুষ্টি – এরকম ক্লান্তিকর মোট ৪০টি বিষয় রয়েছে।
উমা এবং অন্যান্য আশা কর্মীরা যে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করেন, প্রত্যেক মাসের শেষে সেটা রাজ্য সরকারের এনআরএইচএম-এর ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হয়। আমি আরাগের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজির হয়ে দেখলাম যে সেখানে কর্মরতা ২৮ বছরের প্রিয়াঙ্কা পূজারি এই আপলোডিং-এর কাজ নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে তিনটি একতলা বাড়ি। একটাই কম্পিউটার। এছাড়া রয়েছে ডাক্তারের আলাদা একটি ঘর, রুগীদের বসার জায়গা, রক্তপরীক্ষা করার একটি ল্যাব এবং ওষুধ রাখার স্টোররুম। সাধারণত একজন ‘তত্ত্বাবধায়ক’ ১০ জন আশা কর্মীর কাজ দেখেন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সকাল দশটা থেকে সন্ধে ছটা পর্যন্ত কাজ করেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন বাইরের ডাক্তার, একজন নার্স, এবং একজন মেডিকাল টেকনিশিয়ান থাকার কথা, অন্তত খাতায় কলমে।


এই তথ্যগুলো আপলোড করেন আরাগে প্রিয়াঙ্কা পূজারি [বাঁদিকে] এবং অন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্য ফেসিলিটেটাররা যাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে আশা কর্মীদের কাজ তত্ত্বাবধান করা এবং মিটিং পরিচালনা করা।
“এপ্রিল মাস থেকে আশার ওয়েবসাইট গণ্ডগোল করছিল। নভেম্বরে আবার কাজ করতে শুরু করে। আমি এই মাসের তথ্যের সঙ্গে আগের কিছু মাসের বাকি তথ্য-ও আপলোড করছি। অনেক সময় লোডশেডিং এবং দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের কারণে কাজ থেমে যায়,” জানালেন প্রিয়াঙ্কা। প্রিয়াঙ্কা তিন বছর ধরে তত্ত্বাবধায়কের কাজ করছেন। তার আগে তিনি এডুকেশানে স্নাতক স্তর অব্দি পড়েছেন এবং ডিপ্লোমাও করেছে। প্রিয়াঙ্কা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন সরকারি বাসে চেপে বা নিজের স্কুটিতে। তাঁর গ্রাম লিঙ্গনুরের দূরত্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ৭ কিলোমিটার। ওঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে আশা কর্মীদের কাজ তদারকি করা, মাসে মাসে মিটিং করা, এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাঁরা আসছেন তাঁদের সাহায্য করা।
প্রিয়াঙ্কার মাসে রোজগার হয় ৮৩৭৫ টাকা, কিন্তু তার শর্ত হল তাঁকে নবজাতক এবং জন্মের পূর্বকালীন চেক আপের জন্য ২০টি বাড়ি যেতে হবে এবং আশার সাইট আপডেট করার জন্য ৫ দিন বরাদ্দ করতে হবে। “মাসে ২৫ দিন না করতে পারলে আমাদের মাইনে কেটে নেওয়া হয়। মাইনে পাওয়ার জন্য আশা কর্মী এবং ফ্যাসিলিটেটর – দুজনকেই তাঁদের কাজ ব্লক কমিউনিটি মোবিলাইজারদের [ঊর্ধতন কর্মী] কাছে দেখাতে হয়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মাসিক মিটিং-এ প্রিয়াঙ্কা সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীর যৌথ উদ্বেগের কথা বলেন। “কিন্তু কিছুই হয় না,” জানালেন তিনি। “কিছুদিন আগে আমরা [শুধু] এই স্টেশানারি কিট পেয়েছি – ৫০ পাতার ৫টা নোটবই, ১০টা কলম, একটা ৫ মিলি আঠার বোতল, আর একটা স্কেল। এগুলোতে কতদিন চলবে?”
আর যে সমস্যা লেগেই থাকে তা হল চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান। “নিরোধ এবং কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল আমরা শেষ পেয়েছি তিন মাস আগে। যদি কেউ রাতে জ্বর, মাথা ব্যাথা, কোমর ব্যথার ওষুধ নিতে আমাদের কাছে আসে, আমরা দিতে পারি না,” জানালেন ছায়া চবন, বয়স ৪২, যিনি গড়ে মাসে ২০০০/- টাকা সাম্মানিক পান। ওনার স্বামী রামদাস কাছেই একটি চিনির কারখানায় কাজ করে মাসে ৭০০০ টাকা মাইনে পান।


যদিও সরকার আশা কর্মীদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না, শিরামবাই কোরে [বাঁদিকে] বা চন্দ্রকান্ত নায়কের [ডানদিকে] মতো গ্রামের মানুষ কিন্তু তাঁদের শ্রমকে সম্মান করেন
কিন্তু তাও, এই কর্মীদের কাঁধেই রয়েছে গ্রামীণ ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল। দেশের স্বাস্থ্য সূচকের উন্নতিতে এঁদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য নিরীক্ষা-৪ থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০১৫–১৬ সালে মহারাষ্ট্রে শিশু মৃত্যুর হার ২০০৫–০৬-এর ৩৮ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ১০০০-এ ২৪ – লাইভ বার্থের ক্ষেত্রে। আর হাসপাতালে জন্মানো শিশুদের ক্ষেত্রে সেটা ২০০৫–০৬ সালের ৬৪.৬% থেকে বেড়ে হয়েছে ৯০.৩%।
“জনগোষ্ঠী এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে আশা একটি সাঁকো হিসেবে কাজ করে। মা এবং সদ্যোজাতের স্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অপরিহার্য। বারবার বাড়ি যাওয়া, মানুষের সঙ্গে রোগ নিয়ে কথা বলা সাবধান বাণীর কাজ করে," জানাচ্ছেন ডাঃ নিরঞ্জন চবন, মুম্বই-এর লোকমান্য তিলক মিউনিসিপ্যাল জেনারাল হাসপাতালের গাইনেকোলোজিস্ট এবং অবস্টেট্রিশিয়ান।
স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত কোনও পরিস্থিতি তৈরি হলে আশা কর্মীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামনের সারিতে থাকেন। “ছ’মাস আগে লক্ষ্মীওয়াড়িতে [৩ কিলোমিটার দূর] একজনের সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়ল। সেই গ্রামের আশা কর্মী সঙ্গে সঙ্গে আরাগ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে খবর দেয়,” বললেন উমা। “ডাক্তার এবং সুপারভাইসারদের একটি দল সেখানে গিয়ে সমস্ত [৩১৮টি] বাড়িতে গিয়ে নিরীক্ষণ করে। যাদের কোনও রকমের উপসর্গ ছিল তাদের থেকে আমরা রক্ত নিই। আর কোনও কেস ছিল না।”
আশা কর্মীরা যে পরিবর্তন এনেছেন তা কিন্তু গ্রামের মানুষ বুঝতে পারেন। “আমি প্রথম হাসপাতাল দেখলাম দু’বছর আগে যখন আমার ছানি অপারেশান হল,” জানালেন বৃদ্ধা শিরমাবাই কোরে। “উমা আমাদের পথ দেখাল। আমার বৌমা শান্তাবাইয়ের যখন যক্ষ্মা হয়েছিল তখনও দু’বছর [২০১১–১২] তার দেখাশোনা করেছিল। এই অল্পবয়সী মেয়েরা [আশা কর্মীরা] আমার মত বুড়োদের, অল্পবয়সীদের, আর বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করেছে। আমার সময় এরকম কিছু ছিল না। তখন আমাদের পথ দেখানোর কে ছিল?” বললেন শিরমাবাই।



নাসিক জেলার চন্দ্রকলা গাঙ্গুর্দে যশোদার [বাঁদিকে] প্রসবের সময় সাহায্য করেছিলেন। আশা কর্মী হিসেবে নতুন মা-দের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দেখাশোনা করা [মাঝখানের ছবি] তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে, কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে তিনি জানাচ্ছেন [ডানদিকে] যে তাঁর নিজের জীবন একটি সংগ্রাম।
৪০ বছর বয়সী কৃষক চন্দ্রকান্ত নায়কের অভিজ্ঞতাও কতকটা এক। “তিন বছর আগে যখন আমার চার বছরের ভাগ্নীর প্রচণ্ড পেট ব্যাথা আর বমি শুরু হল, তখন কী করব আমরা বুঝতে পারছিলাম না। আমি দৌড়ে উমার বাড়ি গেলাম সাহায্য চাইতে। ও একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকল। আমরা ওকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেলাম...”
আশা কর্মীরা এই জাতীয় আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে অভ্যস্ত। প্রাথমিক খরচটা তাঁরা নিজেরাই দেন। নাসিক জেলার ত্রিম্বকেশ্বর তালুকের তালোয়াড়ে ত্রিম্বক গ্রামের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী আশা কর্মী চন্দ্রকলা গাঙ্গুর্দে বললেন ২০১৫ সালের একটি ঘটনার কথা, “যশোদা সাউরের যখন প্রসব বেদনা শুরু হল তখন রাত আটটা। আমরা প্রায় ৪৫ মিনিট অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করলাম। তারপর আমি পাশের এক বাংলোর মালিকের থেকে তাঁর একটা গাড়ি ভাড়া নিলাম। আমরা ওকে নাসিকের সিভিল হাসপাতালে [প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে] নিয়ে গেলাম। আমি সারারাত ওখানে ছিলাম। ওর মেয়ে হল। সেই মেয়ের এখন তিন বছর বয়স।”
২৫ বছরের যশোদা যোগ করলেন, “আমি চন্দ্রকলা তাঈ-এর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। হাসপাতাল এবং ডাক্তার আমাদের নাগালের বাইরে ছিল। কিন্তু তাঈ সাহায্য করলেন।” হাসপাতালে প্রসব সুনিশ্চিত করার জন্য চন্দ্রকলা কেন্দ্রীয় সরকারের জননী সুরক্ষা যোজনা (প্রসবকালীন মৃত্যু এবং সদ্যোজাতদের মৃতুর হার কমানো এর লক্ষ্য) থেকে ৩০০/- টাকা পান। এর মধ্যে ২৫০/- টাকা তিনি দেন গাড়ির মালিককে আর ৫০/- টাকা খরচ করেন চা-বিস্কুট খেয়ে।
এইরকম পরিস্থিতিতে আশা কর্মীকে অনেক সময়েই হাসপাতালে রাত কাটাতে হয়। যেমন চন্দ্রকলাকে করতে হয়েছিল। এর মানে, খাবার না পাওয়া। বিশ্রামের জায়গাও না পাওয়া। “আপৎকালীন পরিস্থিতিতে খাবার নেওয়ার সময় কার থাকে? আমাদের সন্তান, পরিবার ছেড়ে আমাদের ছুটতে হয়। আমি সারা রাত জেগে ছিলাম। খাটের পাশে মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে শুয়ে থাকি,” জানালেন চন্দ্রকলা। তিনি এবং তাঁর স্বামী সন্তোষ তাঁদের এক একর জমিতে ধান বা গম চাষ করেন। “আমাদের কোনও রবিবার নেই। আমাদের সবসময় সজাগ থাকতে হয়। যে কেউ যে কোনও সময় সাহায্যের জন্য ডাকতে পারে।”

আশা কর্মীদের ইউনিয়ন ও সংগঠন বারবার বেতন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। এই বিক্ষোভটি হয়েছিল ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে সাঙ্গলীর কালেক্টরেট দপ্তরের সামনে
আম্বোলি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১০ জন আশা কর্মী রয়েছেন। চন্দ্রকলা তাঁদের মধ্যে একজন। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিনি মাসে দুবার মিটিং করতে আসেন। এই মিটিং-এ ত্রিম্বকেশ্বর তালুকার অন্যান্য গ্রামের স্বাথ্যকর্মীরাও উপস্থিত থাকেন। “তাঁরা সকলেই একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আশা কর্মীরা নিজেরাই খুব দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন। নিজে আর্থিক সংকটের মধ্যে থেকেও গ্রামের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য পরিশ্রম করেন,” চোখে জল নিয়ে বললেন চন্দ্রকলা।
অন্য আশা কর্মীদের মতো চন্দ্রকলাও চান যে তাঁদের মাইনে বাড়ুক। “এটা কোনও বিশাল দাবি নয়। সাম্মানিক দ্বিগুণ হওয়া উচিত, যাতায়াত এবং অন্যান্য খরচ দেওয়া উচিত। অন্যদের স্বাস্থ্যের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার বিনিময়ে এইটুকু অন্তত আমরা দাবি করতে পারি,” বলতে বলতে গলা ভেঙে এল চন্দ্রকলার।
আশার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেকবার বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে এবং মাইনে বৃদ্ধি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে সরকারের কাছে দাবিও জানানো হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন যে কিছু নিয়মিত কাজের জন্য মজুরি অথবা ‘ইন্সেন্টিভ’ বাড়ানো হবে। যেমন, গ্রামের হেল্থ রেজিস্টার রাখার কাজ করলে আগের ১০০/-টাকার বদলে এখন দেওয়া হবে ৩০০/- টাকা।
কিন্তু স্বাস্থ্য এবং আশা কর্মীরা এই প্রস্তাবের সমালোচনা করেছেন। “বারবার আমরা দাবি জানিয়েছি যে আমাদের মাসে ১৮,০০০/- টাকা [অন্তত] বেতন দিতে হবে। এর সঙ্গে থাকতে হবে বিমা সুরক্ষা ও পেনশন। আশা কর্মীদের স্থায়ী করতে হবে [প্রাপ্য সুবিধে সহ]। ইনসেন্টিভ বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না, জানালেন, মহারাষ্ট্র আশা কর্মী এবং স্বাস্থ্য কর্মী সংগঠনের সভাপতি, সাঙ্গলী নিবাসী শঙ্কর পূজারী।”
অন্যদিকে, আরাগ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রতে, উমা এবং অন্যরা বলছেন যে তাঁরা জানুয়ারি মাসে মুম্বইতে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। “আরেকটা বিক্ষোভ”, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উমা। কী বা করা যাবে? আশাকর্মীরা ‘আশা’-এর ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকেন।
বাংলা অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য