তিন বছর কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে ফেব্রুয়ারি মাসে পান্ডারীনাথ ও কৌশল্যা শেলকের পুত্র রঞ্জিতের বিয়ে পাকা হল। ৫২ বছর বয়সী পান্ডারীনাথের কথায়, “পাত্রীপক্ষের প্রত্যাখ্যান কতটা অপমানজনক তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তাঁরা সবার আগে আমাদের কাছে যে প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিতেন তা হল, ‘কৃষিকাজের বাইরে [পাত্রের] আয়ের আর কোনও উত্স আছে?’”
২৬ বছর বয়সী রঞ্জিত মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদ জেলার খামাসওয়াড়ি গ্রামের চার একর পারিবারিক জমিতে সোয়াবিন, ছোলা এবং জোয়ার চাষ করেন। পান্ডারীনাথ গ্রামের ডাকঘরে কেরানির পদে কাজ করেন, আয় মাসিক ১০,০০০ টাকা। রঞ্জিত নিজেও কিছুদিন চাকরিবাকরি খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি – কাজেই, কৃষিই তাঁর আয়ের একমাত্র উত্স।
পেশায় কৃষি শ্রমিক কৌশল্যা বলছেন, “কেউই এখন আর একজন চাষির সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। বিশেষ করে কৃষকরা নিজেরাই চাষির ঘরে মেয়ে দিতে চায় না। মহাজনদের কাছ থেকে খুব চড়া সুদে মোটা টাকা ধার করে পণ দিয়ে তারা চাকরিজীবী পাত্রের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিতে উৎসাহী। কিন্তু কৃষক পরিবারে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবে না।”
অথচ একটা সময় ছিল যখন বিয়ের বাজারে মারাঠওয়াড়ার কৃষকদের পাত্র হিসেবে খুব চাহিদা ছিল। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার জন্য অবস্থা এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। চাষের সরঞ্জামের ক্রমবর্ধমান খরচ, বাজারে দামের অস্থিরতা, খামখেয়ালি আবহাওয়া এবং দুর্বলতর গ্রামীণ ঋণপ্রদানকারী ব্যবস্থা ইত্যাদি নানান কারণে মারাঠওয়াড়ার বহু কৃষক বর্তমানে ঋণের বোঝায় জর্জরিত।
কৌশল্যা বলছেন, ‘কেউই এখন আর একজন চাষির সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। ...মহাজনদের কাছ থেকে খুব চড়া সুদে মোটা টাকা ধার করে পণ দিয়ে তারা চাকরিজীবী পাত্রের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিতে উৎসাহী। কিন্তু কৃষক পরিবারে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবে না’
খামাসওয়াড়ির ৬৫ বছর বয়সী, অভিজ্ঞ কৃষক বাবাসাহেব পাটিলের মতে এখন সময় পাল্টে গেছে। “আমার ২০ বছর বয়সে, লোকে সরকারি কর্মচারীকে ফেলে কৃষক পাত্র খুঁজত।” কৃষকের পেশার সামাজিক মর্যাদা ছিল, কৃষি থেকে মোটের উপর ভদ্রস্থ এবং স্থিতিশীল আয় হত। “কৃষকের বিবাহযোগ্য পুত্র থাকলে পণ, যৌতুকসহ বিয়ের যাবতীয় শর্ত তারাই নিয়ন্ত্রণ করত।”
হনুমন্ত জগতাপের সংযোজন, কিন্তু এখন, “কৃষিতে আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।” খামাসওয়াড়ি থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে লাতুর শহরে জগতাপ ১৯৯৭ সাল থেকে একটি বিবাহ কেন্দ্র চালাচ্ছেন। মেয়েদের পিতামাতারা এখন গ্রামের বাইরে সম্ভাব্য পাত্রের সন্ধান করেন। তাঁর কথায়, “ধরেই নেওয়া হয়, পাত্র যদি বড়ো শহর বা মফস্সল শহরের লোক হয় তাহলে সে অবশ্যই এমন পেশায় নিযুক্ত থাকবে যার সঙ্গে কৃষির কোনও সম্পর্ক নেই। পাত্রের সন্ধানে থাকা বাবা-মার জন্য ছেলের শিক্ষা ও বেতন প্রাথমিক চিন্তা নয় [অগ্রাধিকার পায় পাত্রের পেশা]।”
বিগত প্রায় এক দশক ধরে জগতাপ এই
পরিবর্তনটি লক্ষ্য করছেন। “এর আগে, আমি গড়ে পনের দিনের মধ্যেই
পাত্রের সন্ধান দিতাম, খুব বেশি হলে মাস দুয়েক লাগত ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে। কিন্তু বর্তমানে
কম করেও ছয় মাস লেগেই যায়। এমনকি এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
আমার পরিচিত অধিকাংশ মানুষজন লাতুরের মতো শহরে অথবা
গ্রামে থাকে। আমি ঔরঙ্গাবাদ,
পুণে বা মুম্বইয়ের খুব বেশি মানুষজনকে চিনি না, অথচ বেশিরভাগ বাবা-মা চায় এইসব
শহরেই তাদের মেয়েরা থাকুক [বিয়ের পর]।”
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, কৃষক পরিবারের ছেলেদের মধ্যে অনেকেই, গ্রামীণ এলাকার প্রচলিত বিয়ের বয়স পেরিয়ে, ২০-এর কোঠার শেষে বা ৩০-এর গোড়ায় পৌঁছেও অবিবাহিত রয়েছেন; পান্ডারীনাথ বলছিলেন, “আমরা অবশ্য ২৩-২৪ বছর বয়স থেকেই পাত্রীর সন্ধান শুরু করে দিই।”
অবশেষে, এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে, পান্ডারীনাথ ও কৌশাল্যা তাঁদের পুত্রের জন্য পাত্রীর সন্ধান পেলেন - রঞ্জিতের হবু স্ত্রী নিকটবর্তী গ্রামের এক কৃষিজীবী পরিবারের পঞ্চম কন্যাসন্তান। “চার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পিতার এমন হাল হয়েছে যে তিনি এখন আর এক পয়সাও ধার করার অবস্থায় নেই। আমরা তাঁকে জানালাম, আপনার মেয়ে ছাড়া আমাদের আর কোনই দাবিদাওয়া নেই। আমাদের তখন মরিয়া অবস্থা আর তাঁরও কোনও উপায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত একটা ভালো সম্বন্ধ হল। কিন্তু আমার ছোটো ছেলের আদৌ বিয়ে হবে কিনা ভাবছি ...”
পান্ডাারীনাথ আরও বলেন, “আমরা কষ্ট পেয়েছি বটে, তবু আমি কাউকে দোষ দিই না। ঘটনা হল, আমার মেয়ে থাকলে আমিও একই কাজ করতাম। একজন কৃষকের থেকে ভালো আর কেই বা জানে চাষির পরিবারের পরিস্থিতি? ফসল ভালো হলে দর পড়ে যায়। আর দর বাড়লে বর্ষার খামখেয়ালিপনা শুরু হয়। ব্যাংক আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। প্রত্যেক কৃষকের মাথায় ঋণের বোঝা। নিজের মেয়ের জন্য এই জীবন কেই বা চায়?”
খামাসওয়াড়ি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বীড জেলার অম্বাজোগাই তালুকের গিরওলী গ্রামের দিগম্বর ঝিরমিলের কথাতেও এই একই সুর ধ্বনিত হয়। দিগম্বর বলছেন, “আমার একটি ১৯ বছর বয়সী মেয়ে আছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে আমি তার জন্য পাত্রের সন্ধান করতে শুরু করব। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছুতেই কৃষক পাত্রের হাতে মেয়েকে দেব না।”
আপেট বলছেন, ‘আমি এমন ঘটনাও দেখেছি যে বিয়ে করার জন্য লোকে জাল নথিপত্র নিয়ে এসে শহরে চাকরি করার মিথ্যা দাবি করে। কিন্তু, বিয়ের পর সত্য উদ্ঘাটন হলে মুখোশ খুলে যায়’
৪৪ বছর বয়সী দিগম্বর নিজের দুই একর জমিতে সোয়াবিন চাষ করেন, এছাড়াও কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। জনৈক মহাজনের কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই তিনি ঋণ নিয়েছেন, মেয়ের বিয়ের পণ এবং যৌতুক বাবদ প্রয়োজন হলে আরও ঋণ নেবেন। “ঋণের উপর সুদ চড়লেও তা এমনকিছু গুরুতর ব্যাপার নয়। অন্তত আমার মেয়েকে কৃষির সঙ্গে জড়িত সংকট এবং জটিলতা ভোগ করতে হবে না। ধার না করলে, আমি হয়তো টাকা [পণ বাবদ] বাঁচাতে পারব, কিন্তু মেয়েকে সারাটা জীবনের [কৃষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে] জন্য দুঃখ কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেব। যদি তার স্বামী চাকরি করে মাস গেলে মাত্র ১৫,০০০ টাকাও উপার্জন করে তাও সেটা অন্তত নিশ্চিত আয় হবে। কৃষক হয়ে আপনি কখনই এমন কোনও নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের কথা ভাবতে পারবেন না, কারণ চাষের কাজে অনিশ্চয়তাই হল একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার।”
চাষি পরিবারে মেয়েদের বিয়ে দিতে পরিবারগুলির অনিচ্ছার জেরে সঞ্জয় আপেটের মতো গিরওলীর বিয়ের সম্বন্ধকারী দালাল বা ঘটকদের জন্য এখন উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন কাজ হয়ে উঠেছে। আপেটের কথায়, “আমি বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে সম্প্রতি ৩৩ বছরের এক পাত্রের বিয়ে পাকা করতে সক্ষম হয়েছি। তাকে নিয়ে আপনি রীতিমতো একটা গল্প লিখে ফেলতে পারেন। আমি তার নাম করব না। কারণ তার বয়স আসলে ৩৭।”
আপেট বলছেন, নানারকম ভাঁওতাবাজি চলে বিয়ের নামে। “আমি এমন ঘটনাও দেখেছি যে বিয়ে করার জন্য লোকে জাল নথিপত্র নিয়ে এসে শহরে চাকরি করার মিথ্যা দাবি করে। কিন্তু, বিয়ের পর সত্য উদ্ঘাটন হলে মুখোশ খুলে যায়। বয়স ভাঁড়িয়ে বিয়ে করা খুবই অসৎ ব্যাপার। কিন্তু,
মিথ্যা চাকরির কথা বলে বিয়ে করলে একজন মহিলার জীবন নষ্ট হতে পারে।”
আপেট বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, তাঁর দুবছরেরও বেশি সময় লেগেছে কৃষক পাত্রের জন্য পাত্রী জোগাড় করতে। “পূর্বে বিবাহ বিষয়ে আলোচনা শুরুই হত পণের পরিমাণ কতটা হবে, পরিবার কেমন ইত্যাদি প্রশ্ন দিয়ে। ইদানীং পাত্র কৃষক পরিবারের নয় জানলে তবেই পরবর্তী কথাবার্তা বলতে পাত্রীপক্ষ উৎসাহী হয়।”
রাধা শিন্দেরও একই অভিজ্ঞতা। তিন বছর আগে অম্বাজোগাই তালুকের মুদেগাঁও গ্রামের একটি কৃষক পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়। ২৬ বছর বয়সী রাধার কথায়, “আমার বাবা-মা দুই বছর ধরে পাত্রের খোঁজ করছিলেন। শর্ত ছিল কিছুতেই কৃষক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যাবে না। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁদের পারিবারের মালিকানাধীন ১৮ একর জমির তত্ত্বাবধান করেন। আমার স্বামী নিজে কৃষিকাজ করেন না। বিয়ের পর তিনি লাতুর শহরে একটি অলংকারের দোকান খোলেন। এই দোকান খোলার পরিকল্পনা সম্বন্ধে তিনি আমার মা-বাবাকে জানানোর পরই তাঁরা বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন।”
আপেট আরও বলেন, “আমাদের গ্রামে অনেক ছেলে আছে যারা হয়তো আজীবন অকৃতদারই থেকে যাবে। কৃষি সংকট ও ঋণের বোঝার পাশাপাশি বারবার এই প্রত্যাখ্যান তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।”
গ্রামের বহু কৃষিজীবী পরিবার হন্যে হয়ে পাত্রীর সন্ধান করে চলেছে বটে, তবে সকলেই যে খোলাখুলি এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক তা নয়, ছবি তোলা তো দূরের কথা। বিয়ের জন্য পাত্রী মিলছে না, এই সমস্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে সলজ্জ, বিব্রত হাসি এবং মাথা নাড়া ছাড়া তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া মেলে না। ২০ একর জমির মালিক সন্দীপ বিদভে জানান, “কেউ মোটেই স্বীকার করবে না যে তাদের পাত্রীপক্ষ প্রত্যাখ্যান করেছে, যদিও এটাই এখানকার বাস্তব।”
অবিবাহিত বিদভে নিজেও পাত্রীর সন্ধান করছেন। তিনি মনে করেন, চাষের কাজ করে এখন আর মানসম্মান, শ্রদ্ধা অর্জন করা যায় না। তাঁর ভাষায়, “এই কথাটা স্বীকার করতে আমার কোনও লজ্জা নেই। মাসিক ১০,০০০ টাকা বেতন পাওয়া ছেলেদের দিব্যি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, অথচ ১০ একর জমি থাকা সত্ত্বেও কৃষক পরিবারের ছেলেরা বিয়ের জন্য মাথা কুটে মরছে। মেয়ের বাবা জিজ্ঞেস করেন: তুমি কী কাজ কর? উত্তর জানার পর তিনি বলেন, আমি শিগগির যোগাযোগ করব। ভালো সম্বন্ধ না পেলে কয়েক মাস পর হয়তো তিনি যোগাযোগ করবেন। তাঁরা নিশ্চিত জানেন ততদিনেও আমাদের মোটেই কোনও পাত্রী জোটেনি।”
সঞ্জয়ের সঙ্গে যখন কথা বলছি, প্রতিবেশী একটি গ্রামের পেশায় পুলিশ এক ব্যক্তি এলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পুলিশ জানালেন, তিন বছর আগে তাঁর বিয়ের সময় তাঁর বাবা ১৫ লক্ষ টাকা পণ বাবদ দাবি করেছিলেন এবং তা পেয়েছিলেন। “আমার না হয় একটা সরকারি চাকরি আছে, কিন্তু আমার ভাই তো একজন কৃষক। এখন আমরা [তার জন্য] পাত্রী খুঁজছি। তিন বছর আগে আমার বিয়ের সময় এবং এখন আমার ভাইয়ের জন্য পাত্রী খোঁজার সময় আমার বাবার মনোভাবের আকাশপাতাল পার্থক্যের কথা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।”
সব শুনে ৪৫ বছর বয়সী বাবাসাহেব যাদব বলেন, তিনি খুব ভালো করেই এই মনোভাবের পার্থক্য বুঝতে পারেন। পেশায় কৃষক বাবাসাহেবের ছয় একর জমি এবং ২৭ বছর বয়সী পুত্র বিশাল আছে। তাঁর কথায়, “আমার ছেলে পাত্রীপক্ষের কাছে বহুবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কয়েকদিন আগে, তাকে সঙ্গে নিয়ে একটা তালুকে গিয়েছিলাম যেখানে বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েরা পাত্রপাত্রীর খোঁজে একত্রিত হয়েছিল। মেয়েদের জিজ্ঞেস করছিলাম তারা কেমন বর চায়। দুজনের কাছে থেকে যখন উত্তর এল, ‘কৃষক ছাড়া অন্য যে কেউ’, তখন সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।”
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর