দিগন্ত বিস্তৃত তুলো খেতের মাঝে হঠাৎই যে জায়গাটায় একদিন চম্পত নারায়ণ জাঙ্গলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, সেটা ছিল নিতান্তই পাণ্ডববর্জিত, রুক্ষ ঊষর।
মহারাষ্ট্রের এদিকটায় এমন মাটির নাম হাল্কি জমিন , অর্থাৎ যে জমিতে মাটির আর্দ্রতা বড়োই কম। পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ শ্যামল একটি টিলা, গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন এই ঢেউ-খেলানো খেতজমির মালিকানা আন্ধ জনজাতির হাতে।
যখন তখন এসে হানা দিত বনবরাহের দল, তাই খড়ে ছাওয়া ছোট্ট একখান চালাঘরের নিচে রোদ-জল-ঝড় উপেক্ষা করে নিজের তুলো-খেত রক্ষা করতেন চম্পত। পাথুরে এ জমির মাঝে আজও অতন্দ্র প্রহরায় ব্যস্ত সেই চালাঘরটি। তাঁর এক পড়শির থেকে জানা গেল, দিন নেই, রাত নেই, খেত পরিচর্যার কাজে ওই চালাঘরটিতেই তিনি নাকি পড়ে থাকতেন।
বছর পঁয়তাল্লিশের চম্পত ছিলেন আন্ধ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। চালাঘর থেকে নিশ্চয় গোটা খামারটাই দেখতে পেতেন, তার সঙ্গে চোখে পড়ত ক্ষয়ক্ষতির অনন্ত দলিল, খর্বকায় বোলহীন কাপাস তুলোর গাছ, হাঁটু অবধি বেড়ে ওঠা অড়হর ঝোপ।
মাসদুয়েক পর ফসল তোলার সময় এলে খেত থেকে যে কিছুই মিলবে না, এটা নিশ্চয়ই নিজেই টের পেয়েছিলেন চম্পত। বকেয়া কর্জের টাকা, পরিবারের দৈনন্দিন খাই-খরচা, এসব মেটানোর মতো একটা পয়সাও ছিল না তাঁর হাতে।
২০২২ সালের ২৯শে অগস্টে সন্ধ্যায় ছেলেমেয়ের সঙ্গে অসুস্থ বাবাকে দেখতে ৫০ কিলোমিটার দূরে নিজের মা-বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন চম্পতের স্ত্রী ধ্রুপদা, এই ফাঁকে মোনোসিলের গোটা একটা ক্যান খেয়ে ফেলেন চম্পত। মারাত্মক বিষাক্ত এই কীটনাশকটি আগেরদিন তিনি ধারে কিনে এনেছিলেন।
পাশের খেতে কাজ করছিলেন এক তুতোভাই, তাঁকে চিৎকার করে ডেকে মোনোসিলের ফাঁকা ক্যানটি এমনভাবে নাড়তে থাকেন, যেন আলবিদা জানাচ্ছেন। তার ঠিক পরমুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন চম্পত, এক নিমেষে বেরিয়ে যায় প্রাণবায়ু।
ঘটনাটির সময় পাশেই অন্য আরেকটা খামারে কাজ করছিলেন চম্পতের কাকু রামদাস জাঙ্গলে (৭০), এই জমিটাও ঊষর পাথুরে। তাঁর কঠায়, “সবকিছু ছেড়েছুড়ে দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।” গাঁ থেকে গ্রামীণ হাসপাতালের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার, আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় লোকজন মিলে গাড়ি ভাড়া করে তাঁকে সেখানে নিয়ে যান বটে, তবে পৌঁছনোমাত্র “মৃত” বলে ঘোষিত হন চম্পত।
*****
মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত ইয়াবতমালের উমরখেড় তেহসিলের এক অখ্যাত গ্রাম নিঙ্গানুর, মূলত আন্ধ আদিবাসী জনজাতির ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের বাস এখানে। হাল্কি জমিনের এ মুলুকে খানিক চাষ হয় ঠিকই, তবে তা দিয়ে নিজেদের খোরাকিটুকুই মেটে কেবল। চম্পত নারায়ণ জাঙ্গলের জীবন তথা মৃত্যু, সব এই মাটিতেই গাঁথা।
জুলাই থেকে মধ্য অগস্ট পর্যন্ত একটানা অতিবর্ষণের পিছু পিছু এসে হানা দেয় জলমগ্ন খরা। ফলত গত দুমাস ধরে কৃষক আত্মহত্যা তুঙ্গে এসে পৌঁছেছে বিদর্ভে।
“প্রায় তিন সপ্তাহ সূর্যের মুখদর্শন করিনি,” জানালেন রামদাস। প্রথমেই ভারি বর্ষায় নষ্ট হয়ে যায় সদ্য পোঁতা বীজ। তাও বা যে কয়েকটা গাছ বৃষ্টি সয়েও বেঁচেছিল, শুখার মরসুম এসে নষ্ট করে দেয় তাদের বৃদ্ধি। তাঁর কথায়, “যখন সার দিতে চেয়েছিলাম, বৃষ্টিটা ধরলোই না। আর এখন যখন বৃষ্টির দরকার, আকাশখানা শুকনো খটখটে।”
আজ দুই দশক পেরিয়ে গেছে, মাত্রাতিরিক্ত কৃষক আত্মহত্যার জেরে খবরের শিরোনাম দখল করে রেখেছে পশ্চিম বিদর্ভের তুলো-বলয়। চাষবাসের এ হেন দুর্গতির পিছনে লুকিয়ে আছে দিনকে দিন বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যা।
১৯টি জেলা মিলিয়ে বিদর্ভ ও মারাঠওয়াড়া অঞ্চল, আবহাওয়া দফতরের (এমডি) জেলাভিত্তিক বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান বলছে যে চলতি বর্ষার মরসুমে গড় হিসেবে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত বৃষ্টি পড়েছে। এর সিংহভাগটাই হয়েছিল জুলাইয়ে। বর্ষাকাল শেষ হতে এখনও প্রায় একমাস বাকি, অথচ এরই মধ্যে ২০২২ সালের জুন ও ১০ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোট ১১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি পড়েছে (বিগত বছরগুলোয় এই সময়টা জুড়ে ৮০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়নি)। বৃষ্টিমুখরতার নিরিখে এবছরটা যেন সত্যিই ব্যতিক্রম।
তবে এরই ফাঁকে ফোঁকরে লুকিয়ে আছে তারতম্য, এই গড়পড়তা পরিসংখ্যানে যা ঠিক বোঝা যায় না। জুন মাসটা ছিল শুকনো খটখটে। জুলাইয়ের গোড়া থেকে এমনই ভারি বর্ষণ শুরু হয় যে মোটে কয়েকদিনেই চুকে যায় বকেয়া বৃষ্টির পরিমাণ। জুলাইয়ের মধ্যভাগে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হড়পা বান বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের খবর আসে। জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে মারাঠওয়াড়া ও বিদর্ভের একাধিক এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের (২৪ ঘণ্টায় ৬৫ মিলিমিটারের বেশি) খবর দেয় ভারতের আবহাওয়া দফতর।
অগস্ট আসতে না আসতেই রাশ টানে আসমান এবং ইয়াবতমাল সহ বেশ কয়েকটি জেলায় সেপ্টেম্বরের গোড়া অবধি চলতে থাকে অনাবৃষ্টির পর্যায়। তারপর সমগ্র মহারাষ্ট্র জুড়ে আবারও বাঁধ ভাঙে আকাশের।
নিঙ্গানুরের চাষিদের বক্তব্য, এই অঞ্চলে একটানা খরার পর এমন দফায় দফায় ভারি-থেকে-অতিভারি বৃষ্টিপাতের নকশাটা যেন ক্রমশ বড্ড চেনা হয়ে উঠছে। আর সর্বগ্রাসী সেই নকশার ফলে কোন কোন ফসল চাষ করবেন, চাষের কোন পন্থা অবলম্বন করবেন, মাটির আর্দ্রতা বা পানি কেমনভাবে রক্ষা করবেন — জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত। এর থেকে জন্ম নিয়েছে এমনই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি যে চম্পতের মতো দিশাহারা কৃষকেরা বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের প্রাণ কেড়ে নিতে।
সম্প্রতি যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনায় বৃদ্ধি হয়েছে, সেকথা বসন্তরাও নাইক শেতকারি স্বাবলম্বন মিশনের প্রধান কিশোর তিওয়ারিও বললেন। সরকার পরিচালিত এই টাস্ক ফোর্সটি কৃষি-সমস্যার মোকাবিলা করতে তৈরি হয়েছে। কেবলমাত্র ২৫শে অগস্ট থেকে ১০ই সেপ্টেম্বরের মাঝেই ৩০জন চাষি আত্মহত্যা করেছিলেন বিদর্ভে, জানালেন তিনি। এটাও বললেন যে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে জানুয়ারি ২০২২ থেকে এখন অবধি হাজারেরও বেশি চাষি আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এঁদের মধ্যে ইয়াবতমালের এক গ্রামের দুই ভাইও রয়েছেন যাঁরা আত্মহত্যা করেছিলেন একমাসের তফাতে।
“যতই সাহায্য করুন না কেন, লাভ নেই; এ বছরের দুর্যোগটা বড্ড ভয়ানক,” বক্তব তিওয়ারির।
*****
জল থইথই খেত-খামার, পচেগলে ভেসে গেছে ফসল, সামনেই যে একটা লম্বা সময় জুড়ে অনটন চলবে, এ কথা হাড়ে হাড়ে জানেন মহারাষ্ট্রের অসংখ্য ক্ষুদ্রচাষি।
মহারাষ্ট্রের কৃষি কমিশনার দফতরের আন্দাজে এ মরসুমের ভেজা-খরার জন্য বিদর্ভ, মারাঠওয়াড়া তথা উত্তর মহারাষ্ট্র জুড়ে প্রায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের চাষিদের বক্তব্য, বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খারিফ শস্য। সোয়াবিন, তুলো, অড়হর — তছনছ হয়ে গেছে সবকটি প্রধান ফসল। শুখামাটির যে এলাকাগুলি মূলত খারিফ শস্যের ভরসাতেই বেঁচে থাকে, এ বছর দুর্যোগের ফলে তাদের মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা সইতে হতে পারে।
অভূতপূর্ব এ বন্যার মূল ধাক্কাটা সয়েছে নদী-নালার পাড়ে অবস্থিত গ্রামগুলি — যেমন নান্দেডের অর্ধপুর তেহসিলের শেলগাঁও। সেখানকার সরপঞ্চ (গ্রাম-প্রধান) পঞ্জাব রাজেগোরের কথায়, “গোটা একটা সপ্তাহ সবরকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। গাঁয়ের ধার দিয়ে বয়ে যায় উমা নদী, সে খেপে গিয়ে আমাদের ঘরদোর মাঠঘাট সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল।” গ্রামের মাইল কয়েক দূরে উমার জল গিয়ে পড়ে আসনা নদীতে, তারপর দুইয়ে মিলে সোজা গিয়ে মেশে নান্দেডের কাছে গোদাবরীতে। অতিবর্ষণের ফলে পাড় ছাপিয়েছিল সবকটা নদীই।
“সারাটা জুলাই ধরে এমন [ভয়ানক] বৃষ্টি হল যে মাঠেঘাটে কাজ করা দায়,” জানালেন তিনি। খয়ে যাওয়া মাটি আর লণ্ডভণ্ড ফসলের দেহে ফুটে উঠেছে সে দুঃসময়ের চিহ্ন। অক্টোবরের দিকে যাতে রবি শস্যের প্রথম বীজ রোওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া যায়, কয়েকজন কৃষক দেখলাম তার জন্য খেতের নষ্ট হওয়া ফসল সরিয়ে-টরিয়ে সাফাই করছেন।
জুলাইয়ের গোড়ার দিকে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ও ফুঁসতে থাকা যশোদা নদীর যুগ্ম রোষে ডুবে যায় ওয়ার্ধা জেলার চাঁদকি গ্রাম, এখানে আজও প্রায় ১২০০ হেক্টর চাষজমি জলের তলায়। ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেস্পন্স ফোর্স (এনডিআরএফ) না থাকলে আটকা পড়া গ্রামবাসীদের উদ্ধার করা যেত না।
৫০ বছর বয়সী চাষি দীপক ওয়ারফাডের কথায়, “১৩টা বাড়ি ধ্বসে যায়, আমারটা সমেত।” বন্যার কবলে ভিটেমাটি খুইয়ে ভাড়াবাড়িতে এসে মাথা গুঁজেছেন এই মানুষটি। “কোত্থাও কোনও চাষবাসের কাজ নেই, এটাই আমাদের সমস্যা; এই প্রথম এমন কামকাজ হারিয়ে বসি আছি।”
“এক মাসে সাত-সাতবার বন্যার মোকাবিলা করেছি। সাত নম্বর বারের বন্যাটা ঠিক তলপেটে মোক্ষম ঘুষি খাওয়ার মতো ছিল; এনডিআরএফের দলগুলো যে সময়মতো পৌঁছতে পেরেছিল, এটাই ভাগ্যি, নয়ত আজ আর বেঁচে থাকতাম না,” তিনি বলছিলেন।
খারিফ শস্যের সলিলসমাধি তো হয়েই গেছে, আপাতত একটাই সওয়াল কুরে কুরে খাচ্ছে চাঁদকিবাসীদের: এবার কী হবে?
বৃদ্ধিহারা তুলোর গাছ আর দুরমুশ হয়ে যাওয়া খামারের এক নারকীয় পটভূমিকার মাঝে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন বাবারাও পাতিল (৬৪), আদৌ যদি কিছু বাঁচানো যায়।
“এবছর কিছু পেতেও পারি, আবার না-ও পেতে পারি,” বলে উঠলেন তিনি, “হাতপা গুটিয়ে ঘরে পড়ে থাকার বদলে চেষ্টা করছি অন্তত কয়েকটা গাছ যাতে আবার করে বাঁচিয়ে তোলা যায়।” এ অর্থনৈতিক সংকটের তল পাওয়া মুশকিল, সবে তো জ্বালা-যন্ত্রণার শুরু।
আজ মহারাষ্ট্র জুড়ে মাইলের পর মাইল চাষজমির দুর্দশার হাল বাবারাওয়ের এই জমিতে ফুটে উঠেছে, এখানে সুস্থ স্বাভাবিক ফসলের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রাক্তন পরামর্শদাতা ও ওয়ার্ধায় কর্মরত আঞ্চলিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ শ্রীকান্ত বারহাট বলছিলেন, “আগামী ১৬ মাস উত্তরোত্তর বেড়ে চলবে এ বিপর্যয়। কারণ ওই সময় কাটার জন্য তৈরি হয়ে থাকবে পরবর্তী ফসল।” তবে কি চাষিরা ১৬টা মাস পেটে কিল মেরেই পড়ে থাকবেন? আসল প্রশ্ন এটাই।
চাঁদকির কাছেই রোহনখেড় গ্রামে থাকেন বারহাটে, সেখানেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক। তাঁর কথায়: “এখন দুটো জিনিস চলছে, মানুষ হয় গয়নাগাঁটি বা অন্যান্য দামি জিনিস বন্ধক রাখছে কিংবা গেরস্থালির প্রয়োজন মেটাতে বেসরকারি সূত্র থেকে ধার করছে, তার সঙ্গে কাজের খোঁজে দেশগাঁ ছেড়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবছে যুবসমাজ।”
এই পরিস্থিতিতে যে বছরের শেষে অভূতপূর্ব মাত্রায় অনাদায়ী কৃষিঋণের মুখোমুখি হবে ব্যাংকগুলি, সেটাও জানালেন তিনি।
শুধুমাত্র চাঁদকি গ্রামেই ২০ কোটি টাকার তুলো নষ্ট হয়ে গেছে — প্রকৃতি সহায় হলে প্রতিবছর তুলোচাষের দৌলতে ঠিক এতটাই টাকার মুখ দেখে এই গ্রাম। এ অঞ্চলে একর-পিছু তুলো উৎপাদনের গড় পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই আন্দাজ করা হচ্ছে সেকথা।
“শুধু যে ফসলের বারোটা বেজে গেছে তা নয়,” বলছিলেন নামদেব ভোয়ার (৪৭), ‘বীজ পোঁতা থেকে প্রস্তুতির প্রতিটা ধাপে যেটুকু খরচা করেছি, [সেটাও] আর ফিরে পাব না আমরা।”
“ধাক্কাটা কিন্তু এককালীন নয়,” হুঁশিয়ারির সুরে বলে উঠলেন তিনি, “মাটি ক্ষয়ের (পরিবেশগত) সমস্যাটা দীর্ঘমেয়াদী।”
এদিকে যখন জুলাই থেকে অগস্ট পর্যন্ত চলতে থাকা অবিরাম বর্ষণে নাভিশ্বাস উঠছে মহারাষ্ট্র জুড়ে শতসহস্র চাষির, অন্যদিকে রাজ্য তখন একরকম সরকারহীন — শিবসেনার অন্তর্দ্বন্দ্বে উল্টে গেছে মহা বিকাশ আঘাডি সরকার।
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে রাজ্যের জন্য ৩৫০০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তার কথা ঘোষণা করে একনাথ শিন্ডের নবগঠিত সরকার। তবে যে পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতির মুখ দেখেছে ফসল, যেভাবে খোওয়া গেছে অসংখ্য জীবন — এ টাকা তার সিকিভাগটুকুও পূরণ করবে কিনা সন্দেহ। এছাড়াও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই টাকা ঢুকতে ঢুকতে বছর ঘুরে যেতে পারে
*****
“আমার খেতটা দেখলেন?” চম্পতের বিধবা স্ত্রী ধ্রুপদা জিজ্ঞেস করলেন, শীর্ণ এই মানুষটির চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল তিন অল্পবয়সী সন্তান — পুনম (৮), পূজা (৬) ও কৃষ্ণা (৩)। “এমন জমিতে আর কী-ই বা আর ফলাবো?” সংসারের অনটন ঘোচাতে চাষবাস ছাড়াও খেতমজুরি করতেন চম্পত ও ধ্রুপদা।
দম্পতিটি গতবছর তাঁদের বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, তাজুলি নাম তার। মুখে যতই সে বলুক না কেন যে তার বয়স ১৬, দেখে কিন্তু কিছুতেই ১৫-এর বেশি মনে হয় না। তিন মাসের একটি ছোট্ট বাচ্চা আছে তাজুলির। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে ধার করতে হয়েছিল, গতবছর এক আত্মীয়কে তাই নামমাত্র মূল্যে নিজেদের খেত ইজারায় দিয়ে আখ-কাটাইয়ের কাজ করতে কোলাপুরে পাড়ি দেন চম্পত ও ধ্রুপদা।
জাঙ্গলে পরিবার যে কুঁড়েঘরটিতে থাকে সেখানে কোনও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বর্তমানে দুটি ভাতও জুটছে না, পড়শিদের সাহায্যে টিকে আছে কোনওমতে। অবশ্য দারিদ্র ও অতিবৃষ্টির দ্বৈরথে প্রতিবেশীদেরও একই হাল।
স্থানীয় জার্নালিস্ট-স্ট্রিংগার তথা চাষি মোইন্নুদ্দিন সওদাগর জানালেন, “এই দেশ জানে গরিবদের কেমনভাবে বোকা বানাতে হয়।” চম্পতের আত্মহত্যার খবরটা তিনিই প্রথম জনসমক্ষে এনেছিলেন। স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক ধ্রুপদাকে ২০০০ টাকা দিয়েছিলেন, সেটাকে রাজকীয় বেইজ্জতি বলে ক্ষুরধার একখান প্রতিবেদন লিখেছিলেন মোইন্নুদ্দিন।
“প্রথমে,” বলছিলেন মোইন্নুদ্দিন, “আমরা ওনাদের এমন জমি দিই যেখানে কেউই যেচে ফসল ফলাতে চাইবে না — গভীরতাহীন মাটি, পাথুরে, ঊষর। তারপর সব রকমের সহায়তা তুলে নিই।” চম্পত যে জমিটুকু বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সেটা দ্বিতীয় মানের, ভূমি সংস্কার আইনের দৌলতে জমিজায়গা পুনর্বণ্টন করা হলে জাঙ্গলে পরিবারের হাতে এই খেতটুকু আসে।
মোইন্নুদ্দিনের কথায়, “মর্দ ও অওরত সব্বাই মিলে দশকের পর দশক ধরে ঘামরক্ত ঝরিয়ে এ মাটি উর্বর করে তুলেছে, যাতে নিজেদের জন্য একটুখানি ফসল ফলানো যায়।” একই সঙ্গে জানালেন — এ অঞ্চলের দরিদ্রতম এলাকাগুলির মধ্যে নিঙ্গানুর অন্যতম, এ গ্রামের সিংহভাগ পরিবারই হয় আন্ধ কিংবা গোণ্ড জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
মোইন্নুদ্দিনের স্পষ্ট বক্তব্য, অধিকাংশ আন্ধ পরিবার এতটাই গরিব যে বেখেয়ালি মরসুমের তাণ্ডব সহ্য করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, ঠিক যেমনটা এবছর হয়েছিল। যাতনা, অনটন ও ক্ষুধার জ্বালা — মোইন্নুদ্দিনের মতে এগুলোর প্রত্যেকটাই আন্ধ জনজাতির সমার্থক শব্দ।
প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দুই ধরনের কর্জই বাকি রেখে মারা গেছেন চম্পত। খানিক পিড়াপিড়ি করাতে ধ্রুপদা জানালেন, ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ টাকা, “গতবছর বিয়েথার জন্য ধার করেছিলাম; এবছর চাষবাস আর নিত্য প্রয়োজন মেটাতে আত্মীয়দের কাছে হাত পাতি। কর্জ মেটানোর মতো অবস্থায় নেই আমরা।”
একে তো পরিবারের চিন্তা, তার উপর ক’দিন ধরে ওঁদের একটি বলদ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উদ্বেগ ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন ধ্রুপদা জাঙ্গলে, “মালিক মারা যাওয়ার পর থেকে আমার বলদটাও খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।”
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)